X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন শিক্ষাক্রমের ভালো-মন্দ

মো. সামসুল ইসলাম
১০ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৩৭আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২১, ১৭:৩৭
মো. সামসুল ইসলাম সদ্য ঘোষিত জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা অনুযায়ী অবশেষে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা থেকে জাতি মুক্তি পেতে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমরা সবাই অনেক লেখালেখি করেছি। এ জন্য আমরা সবাই শিক্ষামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।

সরকার ঘোষিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এখনও ব্যাপক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যসূচি, বিভিন্ন বিষয়, পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা ২০২৩ সাল থেকে কার্যকর হবে। এই পরিবর্তন অনেকটাই বৈপ্লবিক, যা ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার দাবি রাখে। পত্রিকায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে এটি নিয়ে আলোচনা কঠিন। তবু কিছু কথা বলতে হয়।

শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি যাই হোক না কেন, শিক্ষা সম্পর্কিত যেকোনও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে সংশ্লিষ্ট দেশের ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, দর্শন, জনগণের পেশা, নৈতিক স্তর, এমনকি আবহাওয়া ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হয়। বাংলা ট্রিবিউনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমি এ সম্পর্কে আগেও অনেক লিখেছি। যেমন, আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে কাজ করেন। অনেকে পরিবার-পরিজনসহ। আমি দেশে-বিদেশে অনেক পরিবারকে দেখেছি পরিবারের শিশুদের পিইসি, জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে বিপদে পড়তে। আবার ট্রাফিক জ্যাম আর বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশে আরেক স্কুলে নিয়ে গিয়ে শিশুদের পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়া যে কতটুকু কঠিন তা অভিভাবকরা এতদিনে ভালোভাবে জেনেছেন।

শিশুদের পাবলিক পরীক্ষার ধারণা এসেছিল সম্ভবত থাইল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে। থাইল্যান্ডের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। সেখানকার লোকজন আমাদের দেশের মতো ভিন্ন দেশে গিয়ে কাজ করে না। তাদের জনসংখ্যা অনেক কম। তাদের স্কুলশিক্ষকরা এতটাই প্রশিক্ষিত, যা চিন্তার বাইরে। তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা নোট, সাজেশন আর গাইড বইয়ের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের মেধা ও সৃজনশীলতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি। সুতরাং শিক্ষা সম্পর্কিত নীতি নিতে হবে স্ব-স্ব দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী।

শিক্ষা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের নৈতিকতার মানটিও বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশ কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। শিক্ষক এমনকি শিক্ষার্থীরাও যে এর বাইরে তা কিন্তু বলা যাবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কিছু দিন পর পর বুদ্ধিবৃত্তিক চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠছে। আছে শিক্ষার্থীদের মার্কস কমবেশি দেওয়ার অভিযোগ। সুতরাং অন্য দেশের মতো স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের হাতে স্ব-স্ব ছাত্রের মূল্যায়নের ব্যাপারটি কতটুকু যৌক্তিক হবে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

পশ্চিমা দেশের অনেক কিছু আমরা গ্রহণ করি আমাদের দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে। আমি একবার এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে জিজ্ঞেস করছিলাম তারা কেন কোর্স শেষে স্টুডেন্ট ইভালুয়েশন করেন না। উনি যে উত্তর দিলেন তা অবশ্যই যৌক্তিক। একটা পশ্চিমা দেশের শিক্ষার্থীর আচরণ আর আমদের দেশের শিক্ষার্থীদের আচরণের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তার মতে, এমনিতেই সাধারণ শিক্ষকরা শিক্ষক রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতির দাপটে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে পারেন না। তার ওপর স্টুডেন্ট ইভালুয়েশন দিলে অনেককে বিদায় নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা একজোট হয়ে কে কী লিখবে তা বলা মুশকিল। তার ওপর মার্কস ভালো না দিয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া আমাদের দেশে বেশ কঠিন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের যুক্তিগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

আবার মূল প্রসঙ্গে আসি। নতুন শিক্ষাক্রমে যে বিষয়টি  সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে তা হচ্ছে নবম ও দশম শ্রেণিতে বিভাগ উঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটি। শিক্ষার্থী বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষায় পড়বে কিনা তা নির্ধারিত হবে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে গিয়ে। তারা দশটি অভিন্ন বিষয়ে পড়বে।

এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত যার পক্ষে বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেওয়া যেতে পারে বা হচ্ছে। এ পরামর্শ নিশ্চয়ই এসেছে শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে –তারা রাজনীতিবিদদের এর সপক্ষে যুক্তি দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে রাজি করিয়েছেন। গণমাধ্যমে দেখছি, অনেক শিক্ষাবিদই এর সমর্থনে কথা বলছেন। যদিও কেউ কেউ বিপক্ষেও বলছেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়টি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল বলে মনে করি। এ ধরনের সিদ্ধান্তের আগে সর্বপ্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া। বিশেষত, ভবিষ্যতের পেশা বা পড়াশোনার বিষয় সম্পর্কে ফিউচারিস্টরা কী বলছেন সেটি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা। আমি ফিউচারিস্টদের বেশ কিছু লেখায় ভবিষ্যতের পেশা বা বিষয় নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয় এবং পেশার আধিপত্যই তো দেখলাম। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ব্যাপ্তি সংকুচিত করে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করার ব্যাপারটি কি আত্মঘাতী হয়ে গেলো না?

বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে মোটামুটি একমত যে বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করতে হবে অল্প বয়স থেকে। হঠাৎ করে উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিজ্ঞানের বিশাল সিলেবাস সে কীভাবে সামাল দেবে সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। দশম শ্রেণি পাস একজন শিক্ষার্থীর বয়স হবে প্রায় ১৬ বছর। এই বয়স পর্যন্ত তার অর্জিত জ্ঞান এবং দক্ষতা কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের হবে?

কোনও কোনও বিদেশি শিক্ষা বিশেষজ্ঞ দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আগেভাগেই বিভিন্নভাবে ভাগ করে তাদের গড়ে তোলার পক্ষে কথা বলেন। এখানে অভিভাবকদের অর্থনৈতিক ব্যাপারটিও তারা বিবেচনা করেন। নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবককে শিক্ষার্থীর ১৬-১৭ বছর বয়স পর্যন্ত এমন শিক্ষায় বিনিয়োগ করতে হচ্ছে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী কোনও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করবে না।

আমরা যদি তাদের ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তুলনা করি তাহলে এ ব্যবধানটা বুঝতে পারবো। ও’ লেভেলে তারা বিভিন্ন অপশন থেকে পছন্দের বিষয়গুলো বেছে নিয়ে যে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে তা এ’ লেভেলে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ হয়। আমি জানি না নতুন শিক্ষাক্রম আসলে কোন দেশের আদলে তৈরি। কিন্তু আমি আমার আগের লেখায় বলেছিলাম যে খুব বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা না করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশ পদ্ধতি অর্থাৎ আমাদের দেশের ইংরেজি মিডিয়ামের মতো এবং স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের আদলে করা উচিত।

বিশ্বায়নের যুগে এবং শিক্ষার আন্তর্জাতিকীকরণের ফলে বৈচিত্র্য থাকলেও বিশ্বব্যাপী এক ধরনের অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠছে। বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে র‍্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা এর বড় প্রমাণ। এক ধরনের সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করতে চাইছে। উচ্চশিক্ষা-পূর্ববর্তী শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমাদের উন্নত দেশগুলোর রীতিনীতি অনুসরণ করা উচিত।

শিক্ষা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলো ভেবেচিন্তে নেওয়া উচিত। আবেগে সিদ্ধান্ত নিলে জাতিকে এর মূল্য দিতে হবে। আমি যদি সঠিকভাবে মনে করতে পারি, অনেক আগে একবার ডিগ্রি পাসকোর্স থেকে তৎকালীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পরামর্শ আবশ্যিক বিষয় হিসেবে ইংরেজি উঠিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে দেশে ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপক অবনতি ঘটেছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছিল না।

একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান প্রযুক্তির স্বর্ণযুগে যখন রোবটিক্স, ডাটা সায়েন্স, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ড্রোন প্রযুক্তি ইত্যাদি আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাত্রার অংশ, তখন শিশু কিশোরদের বিজ্ঞান শিক্ষা অবহেলা দেশের জন্য ভালো ফল নিয়ে আসবে না। এতে ইংরেজি মাধ্যমের জনপ্রিয়তা বাড়বে মাত্র। আশা করি শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলবেন।

লেখক: কলামিস্ট; বিভাগীয় প্রধান, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

ইমেইলঃ [email protected]
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
নীলফামারীতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ ৩ জন গ্রেফতার
নীলফামারীতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারিসহ ৩ জন গ্রেফতার
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরলো বাংলাদেশ
পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জাতিসংঘে তুলে ধরলো বাংলাদেশ
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানের মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
বার্সার বিদায়ে কান্সেলোর অনাগত সন্তানের মৃত্যু কামনা করেছেন সমর্থকরা!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ