এটা সত্যি, রাস্তায় যে বিপুল পরিমাণ প্রাইভেটকার, বাস কিংবা ট্রাক চলতে দেখা যায় তার একটি বড় অংশই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত মালিকানার। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে ব্যক্তি ও কোম্পানিগুলো তাদের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনা কমাতে সহায়তা রাখতে পারে।
এখানে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। আমাদের কোম্পানি কাজী ফার্মস গ্রুপ (www.kazifarms.com) দেশের সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি প্রতিষ্ঠান। আমাদের মূল ব্যবসা হচ্ছে উত্তরবঙ্গ থেকে ডিম উৎপাদন করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়া। এই কাজটির জন্য আমাদের অনেক ট্রাক প্রয়োজন হয়। সেজন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, যা আপনাদের জানাতে চাই।
প্রথমত আমরা খেয়াল রাখি, প্রশিক্ষিত চালক নিয়োগের বিষয়টি। আমাদের সব চালকেরই বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রত্যেকের লাইসেন্স কপি নেওয়াই যথেষ্ট নয়। কারণ অনেকে ভুয়া লাইসেন্স দেখাতে পারে। তাই আমরা বিআরটিএ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে সব লাইসেন্সের ব্যাপারে নিশ্চিত হই। এছাড়া আমাদের কোম্পানির এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং সফটওয়ারের এইচআর মডিউলে সব লাইসেন্সের মেয়াদের তারিখও জমা রাখি। তাই যাদের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পথে, তাদের প্রতিমাসেই আমরা জানিয়ে দেই।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমরা খেয়াল রাখি, তা হচ্ছে সময়। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একজন চালকের আট ঘণ্টার বেশি গাড়িচালানো নিষেধ। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, আটঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর যে কেউ খুবই ক্লান্ত হয়ে যাবে। তাই নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হবে। আমাদের চালকদের যেহেতু অনেক লম্বা পথ গাড়ি চালাতে হয়, পঞ্চগড় থেকে চট্টগ্রাম কিংবা দক্ষিণ বরিশাল যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে; এজন্য আমরা মাঝপথে আমাদের অফিস রেখেছি। যেন খুব ক্লান্ত হওয়ার আগেই চালক পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে গাড়ি চলন্ত অবস্থায় পর্যবেক্ষণ করা। প্রত্যেকটি গাড়িতে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবহার। এরফলে ঢাকায় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকেই সব গাড়ি পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে এই নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রটি। প্রত্যেকটি ট্রাকের অবস্থান ও গতি পর্যবেক্ষণ করেন আমাদের কর্মীরা। ট্রাকগুলো দ্রুতগতিতে গাড়ি চালালে জিপিএস সেন্সরগুলো সতর্কবার্তা দিতে থাকে, অ্যালার্ম বেজে ওঠে। চালক হয়তো তাড়াহুড়োয় সেটা উপেক্ষা করে গাড়ি চালাতে থাকেন। তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে ওই চালককে ফোন দিয়ে গতি কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে তারা উপলব্ধি করে যে, তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তাই তাদের আরও সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে।
এই সবগুলো পদক্ষেপই নিরাপত্তার কারণে নেওয়া। তবে এটা ব্যয়সাপেক্ষ। প্রশিক্ষিত চালকরা বেশি বেতন দাবি করেন। লম্বা পথের জন্য দুই জন চালক নিয়োগ দেওয়াটা একজন চালকের সাপেক্ষে ব্যয়সাপেক্ষ। জিপিএস সিস্টেম ও কর্মী নিয়োগেও অর্থ খরচ হয়। তবে কাজী ফার্মসের ব্যবসার ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভঙ্গুর ডিম পরিবহন করায় খেয়াল রাখতে হয়, যেন সাবধানে গাড়ি চলে। কারণ ডিম ভেঙে গেলেই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। জিপিএসের মাধ্যমে নজরদারির কারণে তেলচুরি ও অন্যান্য দুর্নীতিও কম হয়। আমরা প্রত্যেক গাড়ির জন্য প্রতি লিটার তেলে কত কিলোমিটার চলবে, সেই মাত্রা নির্ধারণ করেছি। আমাদের কোম্পানির ইআরপি সফটওয়ারটি এই জ্বালানির হিসাব রাখে। প্রত্যেক ট্রিপে কত লিটার তেল নেওয়া হচ্ছে ও কতটুকু খরচ হচ্ছে, সেটা এই সফটওয়ারে লিপিবদ্ধ করা হয়। এতে আমরা দেখতে পাই, কোনও চালক বেশি জ্বালানি ব্যবহার করছেন কিনা। আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। এটা সত্যি যে, নজরদারি বাড়ালে খরচ বাড়ে। তবে এতে অনেক খরচ কমানোও সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের সবাই যদি এই চর্চা করে নিশ্চিতভাবেই তাতে করে অনেক জীবন বেঁচে যাবে। আমি আশা করছি, অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও এই চর্চা শুরু করবে এবং সড়কপথে নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে ও দুর্ঘটনা কমে যাবে। বাংলাদেশের উন্নতির সঙ্গে বেসরকারি খাতের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই জড়িত। তাই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: পরিচালক, টুএ মিডিয়া লিমিটেড