X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ সংকট এবং মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা

জিশান হাসান
২৫ আগস্ট ২০২২, ১৯:২৬আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২২, ১৯:২৬
সাম্প্রতিক সময়ে, বিশ্ব গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় খবর মূল্যস্ফীতি। এমনকি ধনী দেশগুলো যেখানকার গড়পড়তা বেশিরভাগ নাগরিক উচ্চ মূল্যের প্রভাব মোকাবিলায় সক্ষম, সেসব দেশেরও অন্যতম খবর মূল্যস্ফীতি। এর কারণ মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব। যাকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ‘সরবরাহ সংকট’।

বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এবং সর্বনিম্ন মূল্যের গম ও শস্য রফতানিকারক দেশ ইউক্রেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশে ফসল সরবরাহ করতে পারছে না তারা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ইউক্রেনীয় শস্য অদৃশ্য হওয়ায় বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে সরবরাহ থাকা বাকি পণ্য পেতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে ক্রেতারা। এতে স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে।

রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্বালানি সরবরাহ কমে যায়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির ঘাটতি দেখা দেয়। এ কারণে বিশ্বের সর্বত্রই জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় মূল্যস্ফীতি অনিবার্য হয়ে পড়ে।

এমন প্রেক্ষাপটে খুব সহজেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির মূল কারণ আন্তর্জাতিক সরবরাহ সংকট। এর জন্য বাংলাদেশের কেউ দায়ী নয়। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রায়ই বলা হয়, অতিরিক্ত মুনাফা লাভের জন্য শিল্পকারখানার মালিকরা কারসাজি করে অবৈধভাবে পণ্যের মূল্য বাড়ায়। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, সবকিছুর দাম বাড়ার সুস্পষ্ট কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ সংকট।

সবকিছুর দাম বাড়তে থাকলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিম্ন আয়ের জনগণকে টিকে থাকতে স্বাভাবিকভাবেই নানা সমস্যায় পড়তে হয়। তাহলে বিদ্যমান সরবরাহ সংকটে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সরকারের করণীয় কী?

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ সংকটের সময় সরকারের প্রথম কাজ হওয়া উচিত, প্রকৃত সমস্যা কোথায় রয়েছে তা শনাক্ত করা। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণত, নিম্ন আয়ের মানুষ খাদ্য ও বাসস্থানের মতো অতিপ্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ করতে পারে না।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মজুরি বাড়ানো প্রয়োজন। যাতে তারা বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, নিয়োগকর্তাদেরও একটি নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে, কর্মচারীদের এমন মজুরি নিশ্চিত করা, যাতে তারা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারে। যেহেতু ন্যূনতম মজুরি সাধারণত সরকার নির্ধারণ করে, তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে অপুষ্টি রোধে মজুরি বাজারে সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত তৈরি পোশাক। সরকার সাধারণত প্রতি পাঁচ বছর পর এই খাতে ন্যূনতম মজুরি বাড়ায়। সবশেষ ২০১৮ সালে তৈরি পোশাক খাতের কর্মীদের সর্বনিম্ন মজুরি শতকরা ৫০ ভাগ বাড়িয়ে প্রতি মাসে ৮০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর অর্থ হলো আবার তাদের সর্বনিম্ন মজুরি সমন্বয় করা হবে ২০২৩ সালে (৫ বছর ব্যবধান ধরে)।

কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী দেখা দেওয়া খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ সংকট এবং মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে, শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অপুষ্টি রোধে সরকারের উচিত এই বছরের মধ্যেই মজুরি বাড়ানো। আর পোশাক শিল্পের সঙ্গে শ্রমিক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা অন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকেও অনিবার্যভাবে ন্যূনতম মজুরি বাড়াতে হবে।

সরকারের উচিত মূল্যস্ফীতি বাড়ায় এমন বিষয়গুলো দূর করা। কারণ, এতে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। এমন ঘটনা ঘটে যখন মানুষ দেখে পণ্যমূল্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে, কিন্তু টাকার মূল্য কমছে এবং আরও কমার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ সাধারণত অতিরিক্ত পণ্য কেনার চেষ্টা করে। তারা মনে করে, কাল টাকার মান আরও কমতে পারে, তাই আজই কিনলে কিছুটি হলেও বেশি পণ্য পাওয়া যাবে।

সবাই একসাথে পণ্য কিনতে চেষ্টা করায় প্রতিযোগিতা বাড়ে। ফলে বেড়ে যায় পণ্যমূল্যও। যার অনিবার্য পরিণতি মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাওয়া।

মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে এমন সম্ভাবনা দূর করার যৌক্তিক উপায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো। সুদের হার হলো ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার মূল্যমানের একটি বাস্তবভিত্তিক পরিমাপক। যখন সুদের হার বাড়ে তখন জনগণ দেখতে পায় টাকার মূল্য বাড়ছে, কমছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে এমন শঙ্কাও কমে আসে। এ কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের সর্বজনীন পদ্ধতি ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত সুদের হার বাড়াতে চায় না। কারণ, এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে মন্থর করে। ব্যবসায়ীরা নতুন কারখানা বা প্রকল্প চালু করার সময় ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করেন। কম সুদে ঋণ পেলে তাদের জন্য সুবিধা। এগুলো কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পাশেই থাকতে চায়। দুর্ভাগ্যবশত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আর কোনও বিকল্প নেই। তাই সরকারকে একইসঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। কারণ, একইসঙ্গে দুটো করা সম্ভব নয়।

বৈশ্বিক সরবরাহ সংকটে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি সমাধানের সহজ কোনও উপায় নেই। যদিও সরকারের বিচক্ষণ নীতি সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সদস্যদের ওপর থেকে মূল্যস্ফীতি জনিত ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে। সেই সঙ্গে মূল্যবৃদ্ধির সময়কাল ও সীমা কমতে পারে। তাই সরকারের উচিত ন্যূনতম মজুরি এবং ব্যাংক সুদের হার বাড়ানো।

লেখক: পরিচালক, কাজী মিডিয়া লিমিটেড এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিসনোভা
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
শিল্পী সমিতির নির্বাচন, মিশা-ডিপজলে কুপোকাত কলি-নিপুণ
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ