সরকারি হাসপাতালের সুস্বাস্থ্য জরুরি

তুষার আবদুল্লাহআমাদের স্বাস্থ্যখাত অসুস্থ, এই খবরটি পুরনো। দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে চিকিৎসা ব্যবস্থা–এ কথা শুনে কেউ এখন আর আতঙ্কিত হয় না। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রথমে প্রার্থনা করে, যেন হাসপাতালে যেতে না হয়। দ্বিতীয় প্রার্থনা, অসুখকে যদি প্রতিরোধ বা দূরে রাখা না যায়, তাহলে যেন একজন মানবিক চিকিৎসকের দেখা মেলে। মানবিক ও প্রকৃত চিকিৎসকের দেখা পেলে একজন রোগীকে অতিরিক্ত ও অযথা পরীক্ষা- নিরীক্ষা করতে হবে না। প্রয়োজন না থাকার পরও বহন করতে হবে না হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চাপ। ভর্তি হলে অপ্রয়োজনীয় ও ভুল চিকিৎসা বা অস্ত্রপচারের ঝুঁকি আছে। বিনা কারণে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ)-তে নিক্ষেপের শঙ্কা থাকে। মৃত্যুর পরও ওই ঘর থেকে মুক্তি মেলে না। কারণ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রত্যাশিত ‘বিল’ না তোলা পর্যন্ত ছাড় দিতে নারাজ। এক তারকাখচিত হাসপাতাল ও প্যাথলজিক্যাল ল্যাবে কর্মরত একজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল সেদিন। তিনি জানালেন, তাদের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মাসিক আয় কমপক্ষে দুই কোটি টাকা। যার আশি ভাগই লাভ। এই লাভের টাকার বাইরে আছে চিকিৎসকদের কমিশন। চিকিৎসকরা অপ্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে কমিশন পান। চিকিৎসকরা চাইলে তাদের পরিচিতদের ৬০ ভাগ পর্যন্ত ছাড় দিতে পারেন। এ থেকে অনুমান করা যায়, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার প্রকৃত খরচ কত।  এ আলাপগুলো মূলত বেসরকারি হাসপাতাল প্রসঙ্গেই বলা হলো। যদি বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিত কারও সূত্রধরে বেসরকারি হাসপাতালে না যাওয়া হয়, তাহলে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তা সেই অভিজ্ঞতা কম বেশি সবারই আছে। পরিচিতজন থাকলে অন্তত রোগীর খোঁজ-খবর নেন সেবিকা ও চিকিৎসকরা। ব্যবহারও খানিকটা সইয়ে নেওয়ার মতো হয়। তবে কেবিন ও ওয়ার্ড ভাড়ার বেলায় খুব একটা সুবিধা হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে জরুরি সেবা নিতে গিয়ে সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন এমন রোগী ও পরিজন কম। একটু ঝুঁকি দেখলেই রোগী রাখতে নারাজ তারা। আবার জরুরি বিভাগও যথাযথভাবে তৈরি নয় খ্যাতনামা হাসপাতালগুলোর।

যতটুকু সেবা জোটে, সেটি সরকারি হাসপাতালেই জোটে। এখানে রোগীর প্রবল স্রোতের মাঝেও সেবা দিতে তৎপর থাকেন সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। অন্তত জরুরি সেবায় সরকারি হাসপাতালের জুড়ি এখনও মেলেনি। তবে সমস্যার জায়গা হলো সরকারি হাসপাতাল ঘিরে তৈরি করা আছে দালাল চক্র। সেবক-সেবিকা ও কর্মচারীদের সিন্ডিকেট। চিকিৎসকদের রাজনৈতিক বিভক্তি। এমন কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালে দৌড় দেওয়ার তাড়না। এর সঙ্গে যোগ হয় অস্ত্রপচার,  প্রয়োজনীয় পরীক্ষার যন্ত্রপাতির অভাব ও বিকল হয়ে থাকা। ফলে সরকারি হাসপাতাল থেকে তুষ্ট হওয়ার মতো, নিশ্চিত হওয়ার মতো সেবাও পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে সিন্ডিকেট চক্রকে ম্যানেজ করে নিতে পারলে বরাতে কিছু সেবা জোটে। নাহলে বারান্দায়, মেঝেতে শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণা বাড়ানো ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না অনেক অসহায় রোগীর। সরকারি হাসপাতালের কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও আছে।  কার্যদিবস বা সময়ের পর রোগী ভর্তি হওয়া মুশকিল। রোগীর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতেও আছে নির্ধারিত সময়ের পরে নানা জটিলতা। সরকারি হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা সব সেবা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

হাসপাতালের অসুখ নিয়ে যখন লিখছি, তখন গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের অপারেশন থিয়েটার অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে হৃদরোগের জটিল অপারেশন। কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে রোগী ভর্তিও বন্ধ। অপরাশেন থিয়েটারে জীবাণু সংক্রমণ হয়ে কয়েক সপ্তাহে ৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিশ্চিত করেনি বা গোপন করে গেছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর স্বীকার করেছে ঘটনা সত্য। হাসপাতালটির জীবাণু সংক্রমণ পরিশোধনকারী যন্ত্রটিও নাকি জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত। ৪২টি উপকরণ সংগ্রহ করে বিশেষ পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সংক্রমণ মুক্ত করার জন্য ২২ দফা সুপারিশও করা হয়েছে। সেই সুপারিশ কবে বাস্তবায়িত হবে,  বলা মুশকিল। তবে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের অপারেশন থিয়েটারকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতেই হবে দ্রুতি। কারণ সাধারণ রোগীদের ভরসা এবং দেশের হৃদরোগ চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য হাসপাতালও এটি। তাই এই হাসপাতাল নিজেই যেন অসুখে না পড়ে, সেই নজরদারি থাকা উচিত ছিল। দেশের চিকিৎসা সেবাকে সাধারণের ভরসার জায়গায় নিতে হলে, সরকারি হাসপাতালগুলোকে অসুখে ভুগতে দেওয়া যাবে না। হাসপাতালের সুস্বাস্থ্য সাধারণ রোগীদের সুচিকিৎসার নিশ্চিত করতে পারে অনেকটাই।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি