কৈশোর তারুণ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেশের নানা প্রান্তের স্কুলে যেতে হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলি। স্কুলে কিছু সময় কাটানোর কারণে, স্কুল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই কোচিংয়ের মতো বিষয়গুলো আড়ালে রাখতে পারেন না। কারণ স্কুল সময়ের পরেও যখন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্কুলে রয়ে যান, তখন দেখা যায় জমে উঠতে থাকে স্কুল কোচিং। বিষয়গুলো রাজধানীসহ দেশের সব জেলা-উপজেলা শহরেই প্রকাশ্য। আরেকটি বিষয় এখন প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে, গাইড বই বা সহায়ক বই বাণিজ্যের সঙ্গে শিক্ষকদের সরাসরি সম্পর্ক। যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো গাইড বা সহায়ক বই প্রকাশ করে, তাদের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি থেকে শুরু করে সাধারণ শিক্ষকরা। তারা ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্য করেন তাদের সঙ্গে চুক্তি হওয়া বা কমিশন পাওয়া প্রকাশনীর গাইড বই কিনতে। ওই গাইড বই থেকে উত্তর না লিখলে নম্বরও পাওয়া যায় না। প্রকাশনীগুলো এখন স্কুল-কলেজ দখল করে অনেকটা নিলামের ভিত্তিতে। যে প্রকাশনী যত বেশি টাকা দেবে শিক্ষকদের, সেই প্রকাশনীর বই ওই স্কুল-কলেজে প্রবেশ করতে পারবে। স্কুল-কলেজের নানা রকম অনুষ্ঠানের স্পন্সর করছে গাইড বই প্রকাশকেরা। ফলে কৃতজ্ঞতাবশত তাদের গাইডবই শিক্ষার্থীদের হাতে তো তুলে দেবেনই শিক্ষকরা। গাইড বই ব্যবসায়ীরা কোনও কোনও স্কুল-কলেজে বাৎসরিক কোটি টাকার ওপরে ব্যবসা করছেন। ফলে দেখতে পাচ্ছি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা মূল পাঠ্যপুস্তক প্রায় ছুঁয়ে দেখছে না বলা যায়। আমরা কৈশোর তারুণ্যে বই-থেকে বইমেলা আয়োজন করার সময়ে শিক্ষার্থীদের মুক্তগদ্য লিখতে বলি। শিক্ষার্থীরা ৩০০-৫০০ শব্দের মধ্যে নিজের মতো করে কিছু লিখুক, সেটাই আমরা চাই। সাধারণ কিছু বিষয় দেওয়ার পর দেখলাম, যে বিষয়গুলো গাইডবইতে পাওয়া যাচ্ছে, সেই বিষয়ে হাজার শব্দ লিখে ফেলছে তারা। একই লেখা সবাই লিখছে বিরতি চিহ্নসহ হুবহু এক। কিন্তু গাইড বইয়ের সঙ্গে মিলবে না এমন বিষয় দেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের হাতেগোনা কয়েকজন ছোট করে কিছু লিখে দিতে পারছে। আমরা তাতেই আত্মহারা। যাক নিজে থেকে লিখতে পেরেছে কেউ।
কিন্তু কোচিংয়ের বিরুদ্ধে এত অভিযান। সেই অভিযানের ফলতো দেখা যায় শূন্যই। স্কুলের কোচিং যখন বন্ধ করা গেলো না, তখন আর অভিযানের ফল খুঁজে লাভ কী? স্কুলের বাইরের কোচিং সেন্টারের বাণিজ্য এখনও রমরমা। গাইডবই ব্যবসায়ীদের টাকার উত্তাপে শিক্ষকরা নিজেদের নৈতিকতা বিকিয়ে দিচ্ছেন তাদের কাছে। শুধু কি শিক্ষক? শিক্ষার নীতি-নির্ধারকরাও এই বেচা-বিক্রির বাইরে নন। অতএব যতদোষ সন্তানদের কাঁধে কেন তুলে দেই? ওরা পাঠ্যসূচির বাইরের কিছু শিখছে না। কোচিং ছাড়া ভালো ফল করতে পারছে না। এর সব দায় কিন্তু আমাদেরই। সন্তানদের আমরা পণ্য বানিয়ে বাণিজ্য করছি, এখানে শিক্ষার মান খুঁজে লাভ নেই।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি