‘দেউলিয়া’ সংস্কৃতি

তুষার আবদুল্লাহপূর্বরাত্রি-পূর্বদিনে ফিরে তাকালে দেখবো, স্বাধীনতার পর আমাদের সমাজে কেবল পুঁজির বুঁদ বুঁদ উঠতে শুরু করেছে। ঠিকাদার ও ডিলার শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। বাড়তি টাকা তাদের পকেটেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সমাজে একটা নতুন বণিক শ্রেণি তৈরি হয়। অভিজাত এলাকায় বাড়ি, নতুন গাড়ি আঁকড়ে তারা উঁচুতলার ওঠার সিঁড়িতে পা রাখেন। সিঁড়ি ভেঙেই তখন ওপরে উঠতে হয়েছে। লিফট সুলভ ছিল না। এছাড়া তখনকার দালানের উচ্চতা দুই বা সর্বোচ্চ চারেই সীমিত ছিল। বাড়ির সামনের লনের দৈর্ঘ্য-প্রস্থও বুঝিয়ে দিতো আভিজাত্যের মাপ। এই সময়টি গত শতকের ৭০-থেকে ৮০’র দশক। এ সময়কালে ক্লাব সংস্কৃতি, ইউরোপ-আমেরিকার অভ্যাসকে নিজেদের যাপনে যুক্ত করার অহংবোধ ছিল। এটি যেমন পোশাকে, বাড়ি-অফিস সজ্জায়, খাবার এবং কথা বলার ভঙ্গিমাতেও। কোল্ড না কফি, বা গরম না ঠাণ্ডা ছিল এই প্রক্রিয়ার বাহ্যিক জনপ্রিয় রূপ। আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানের কথা বার্তায় আমরা কতটা আমেরিকা ইউরোপের অভ্যাস আয়ত্ত করতে পারছি তার এক প্রকার প্রতিযোগিতা চলতো। সেখানে নিজেদের নৈপূণ্যের ওপর দাঁড়িপাল্লায় মাপা হতো, কতটা শ্রেণিচ্যুত হয়ে আমরা ঊর্ধ্বগামী হতে পারলাম। সেই যে আমরা মরিচকে ‘চিলি’, চামচ কে ‘স্পুন’ বলতে শুরু করেছিলাম, সেখান থেকে আমরা সরে আসতে পারিনি এখনও। মাঝে আমরা ইউরোপ-আমেরিকা থেকে খানিকটা সরে ভারতীয় সংস্কৃতিমুখি হই। বলে রাখা ভালো ভারতীয় মূল সংস্কৃতিকে আমরা অনুসরন করেনি। করেছি দৃশ্যমাধ্যমে প্রদর্শিত আরোপিত এক ফ্যান্টাসি যাপনকে। যেই অভ্যাস বা জীবনের সঙ্গে ভারতের কোন অঞ্চল বা গোষ্ঠীর যাপনের মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। দৃশ্যমাধ্যম থেকে তুলে আনা ফ্যান্টাসিকে আমরা আমাদের আচারে জীবনরূপ দিতে শুরু করি। সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের নিজস্ব যে রীতি ছিল সেটা পাল্টে দেই, বদলে যায় পোশাকের নকশা, খাবার রন্ধন প্রক্রিয়া এবং আমাদের বচন। আমরা এবার আরেকধাপ উঁচুতে লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করলাম। এতক্ষণে কিন্তু পুঁজি বা স্বচ্ছলতা শুধু ঠিকাদার আর ডিলারে আটকে নেই। বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়েছে সকল পেশাতেই। দুর্নীতির জোয়ারকে রুখতে পারেনি নৈতিকতার বাঁধ। ফলে অভিজাত হওয়ার দৌড় ম্যারাথনে রুপ নেয়। নিম্নমধ্যবিত্ত লক্ষ্য ঠিক করে উচ্চবিত্তের কোঠায় পা রাখার। মধ্য ও উচ্চমধ্যবিত্ততো এই স্বপ্নে বিভোর থাকেই। এতদিনে অবশ্য সিঁড়ি মাড়িয়ে ওপরে ওঠার অভ্যাসটাও চলে গেছে। লিফট এসে গেছে। তরতরিয়ে উপরে ওঠে যাওয়ার শতভাগ গ্যারান্টি নিয়ে। তবে ভারতীয় দৃশ্যমাধ্যমে অবস্থান করেই আমরা আবার চোখ সরিয়ে নেই মরুপথে।

আমাদের দেশে ইসলামসহ নানা ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের বসবাস। সকলেই নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছিলেন নিজ দেশের সংস্কৃতি ও অভ্যাসকে অক্ষুণ্ন রেখেই। এতে তাদের ধর্ম চর্চায় কোনও বিঘ্ন ঘটেনি। বরং সকল মতের মানুষ মিলে একে অপরের উৎসবে শরিকও হতেন। এখনও সেই অভ্যাস বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। কিন্তু ব্যক্তিগত অভ্যাসে আমরা মরুদেশের আচার আয়ত্ত করতে শুরু করি। বিশেষ করে পোশাকের ক্ষেত্রে। এবং পারিবারিক অন্যান্য আচারে। এর অনেক আচার আবার সেখান থেকেই উড়ে গেছে অনেক আগে। কারো কারো পর্যবেক্ষণ আমাদের জনশক্তি এই মরুদেশ থেকে এই আচার আমদানি করে নিয়ে এসেছে। সমাজের উঁচুতলার মানুষেরা সেখানকার বৈভবের সঙ্গে নিজেদের আত্মীকরণ করতে গিয়েও ধরেছে সেই বেশ।

আর্থিক সচ্ছ্লতার এই সময়ে এসে আমরা সংস্কৃতির দেউলিয়াপনায় পড়েছি। ইউরোপ, আমেরিকার প্রতি আমাদের টান কমেনি। বরং আরও তীব্র হয়েছে। মরিচিকা বিশ্বাস ও বৈভবে আমাদের কাছে বেড়েছে মরুর কদর। ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশকেও আমরা রুখতে পারছি না। তার ফলাফল দেখতে পাই আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানে, পারিবারিক সম্মিলনে। এমনকি একা কোনও চা-কফি বা অন্য খাবারের দোকানে গিয়ে বসলেও। পোশাকে বাঙালিয়ানা নেই। মুখের বুলিতে কখনও ইংরেজি কখনও হিন্দি। করুনা করে দুই একটি বাংলা শব্দ আসে। ইংরেজি ও হিন্দির যে শুদ্ধ বয়ান তাও বলা যাবে না। তারা বরাবরই টেবিল আঁকড়ে লড়াইতেই ব্যস্ত। কে কতটা বিদেশ লগ্ন। সদ্য কে কোথা থেকে ফিরলেন। কোথায় যাচ্ছেন। স্থায়ী বসতের জন্য কোন ভূমি বেছে নিচ্ছেন। সন্তানরা যে বাংলা মাধ্যমে পড়ছে না, ইনিয়ে বিনিময়ে সেই কথাটিও জানিয়ে রাখতে হয় চা, কফি, স্যুপকে সাক্ষী রেখে। অনার্থের অর্থ পকেট উপচে পড়ছে। লিফটে চকিতে উপরতলাতেও উঠে যাওয়া গেছে, কিন্তু কখন যে মন-শরীর থেকে সংস্কৃতি খসে পড়েছে আমরা টের পাইনি। আজকাল লিফটে ওঠানামার সময় যাত্রীদের জন্য নানা রকম নির্দেশনা লেখা দেখি। সেখানে এই  নির্দেশনাটিও মনে হয় যোগ করা যেতে পারে– নিজ অভ্যাস ছুঁড়ে দেবেন না। পরের যাপনে যাপিত হলে পতন অনিবার্য। উচ্চতায় টেকসই হতে চাইলে,নিজ আচারে আস্থা রাখুন।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি