১৯৮১ সালে জিয়ার মৃত্যুর পর তার উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সংবিধান সংশোধন করে ১৯৮১ সালের ১৫ই নভেম্বর বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করেন। সংবিধান সংশোধন করার তীব্র বিরোধিতা করেন ড. কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ড. কামাল হোসেন সেই নির্বাচনে বিচারপতি সাত্তারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। অবধারিতভাবে সেই নির্বাচনের ব্যাপক ভোট ডাকাতি, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিচারপতি সাত্তারকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। ফলাফল ঘোষণার আগেই তিনি হোটেল পূর্বাণীতে এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেন– ‘ধানের শীষ প্রতীক বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে। ধানের শীষ প্রতীক হলো প্রতারণার প্রতীক। ধানের শীষ হলো জনগণের ভোটাধিকার হরণের প্রতীক। এই প্রতীকের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাসে কলঙ্ক রচনা করা হয়েছে’। ড. কামাল হোসেন বর্তমানে সেই ধানের শীষের রক্ষাকর্তা। মাঝখানে মাত্র ৩৭ বছর পার হয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ড. কামাল হোসেনের জীবন ও কর্মচর্চা করেন তারা কখনও এসব ইতিহাস বলেন না। তারা কখনও বলেন না ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জনগণ দুর্নীতির দুর্গ হাওয়া ভবন ঘেরাও করতে গিয়েছিল। তারা বলেন না এই ড. কামাল হোসেন এরশাদ পতনের পর বলেছিলেন, তিনি গুলশানে দেখেছিলেন কিছু মানুষ গরুর দড়ি নিয়ে এরশাদের উপ-রাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদকে খুঁজছে।
এরশাদ পতনের পর ১৯৯১ সালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে ক্ষমতায় এসেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের সেই আঁতাত প্রকাশ্যেই হয়েছিল। এই নির্বাচনের বিএনপি-জামায়াত জোটকে জিতিয়ে আনার মূল কারিগর ছিলেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু সাঈদ। সেই নির্বাচনকে নিজের আওতায় আনার জন্য বিচারপতি লতিফুর রহমান শপথ নেওয়ার আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন প্রশাসনে কী ধরনের পরিবর্তন আনবেন এবং শপথের আগেই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উঠেছিলেন। এই সবই শুধু বেআইনিই ছিল না অসাংবিধানিকও বটে। সেই নির্বাচনে বিএনপিকে জিতিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিপুল অর্থ ব্যয় করেছিল, যা আইএসআ ই’র তৎকালীন প্রধান জেনারেল আসাদ দুররানি লাহোরের আদালতে দেওয়া হলফনামায় পরবর্তীকালে স্বীকার করেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছিল বিচারিক ক্ষমতা, যা তারা অনেক স্থানে অপব্যবহার করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের এলাকা ছাড়া করেছিল। নির্বাচনের দিন অনেক এলাকায় স্বয়ং প্রার্থীকে পুকুরের পানিতে তারা দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। আর যে সকল সরকারি কর্মকর্তা শেখ হাসিনা সরকার প্রধান থাকাকালে বেশুমার সুযোগ সুবিধা নিয়েছিল তারা রাতারাতি ভোল পাল্টে ফেলেছিল। একটি উদাহরণ ফেনী। সেখানে তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন সোলেমান চৌধুরী। তিনি একসময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময় সরকার ও তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছ হতে নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন তিনি। নির্বাচনের সময় শুধু আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়নাল হাজারীকেই এলাকা ছাড়া করেননি, আওয়ামী লীগের সমর্থকদেরও বাড়ি ছাড়া করেছিলেন। এবারও তা হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করে। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দেশ হয়ে ওঠে দুর্নীতি, অপশাসন, দ্বৈত শাসন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন, জঙ্গিবাদের উত্থান, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র জোগানের শাসনকাল। আওয়ামী লীগ ২০০৮-এর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে। বিএনপি বিরোধী দলে বসলেও সংসদকে অকার্যকর করার জন্য পুরো মেয়াদে নানা রকমের চেষ্টা করে। এরমধ্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। তারা তখন গোঁ ধরে দশম সংসদ নির্বাচন এই বেআইনি ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত না হলে নির্বাচনে যাবে না। আদালতের রায়ে বলা ছিল, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এক মিনিটের জন্যও দেশের শাসনভার কোনও অনির্বাচিত ব্যক্তির হাতে যাওয়া উচিত নয়। বেগম জিয়া তা মানতে নারাজ। তাকে হাওয়া দিলেন দেশের কিছু মিডিয়া আর সুশীল নামধারী ব্যক্তি। নির্বাচন যতই এগিয়ে এলো দেশে শুরু হলো অস্থিরতা। শেখ হাসিনার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার স্বার্থে বেগম জিয়াকে আমন্ত্রণ জানালেন নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে। এমনও বললেন তিনি যে ক’টা মন্ত্রণালয় চান তা তিনি নিতে পারেন। একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বেগম জিয়াকে নিজে ফোন করে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য গণভবনে আমন্ত্রণও জানালেন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। আধঘণ্টা ধরে বেগম জিয়া অত্যন্ত অসৌজন্যমূলকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে বকাঝকা করলেন।
যখন আর কোনও সাংবিধানিক পথ খোলা রইলো না তখন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলো। এই নির্বাচন বানচাল করার জন্য দেশব্যাপী শুরু হলো জনগণের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ পেট্রোলবোমার যুদ্ধ। আগুনে পুড়ে নিহত হলো প্রায় তিনশত নিরীহ মানুষ। বাদ গেলো না শিশু বৃদ্ধ। নিহত হলেন দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আর নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তা। সারা দেশে ধ্বংস করা হলো কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এক ভয়াবহ প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলো সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করেন। দেশব্যাপী তাণ্ডব কিন্তু থেমে থাকেনি। চলেছে প্রায় এক বছর।
গত পাঁচ বছরে দেশে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সরকারের দুই মেয়াদ দেশের যে সার্বিক উন্নয়ন হয়েছে তা এখন বিশ্বে স্বীকৃত। এরই মধ্যে দশ বছর বিচারকার্য চলার পর বিএনপি প্রধান বেগম জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে আদালত দশ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তিনি এখন কারাগারে। তার পুত্র তারেক রহমানকেও একই অভিযোগে ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তিনি এখন লন্ডনে পলাতক। দলের দুই শীর্ষ নেতাই দণ্ডিত ও কারাগারে অথবা পলাতক। শুরু হতেই দলটি জিয়া পরিবার নির্ভর। দলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক তাদের পরিবারের সদস্যদের, বাইরের অন্য কেউ নন। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন বেগম জিয়া ছাড়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবেন না। আর অনির্বাচিত নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া শেখ হাসিনার অধীনে কোনও নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। শুধু তাই নয়, কোনও নির্বাচনই করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু বিপদ হচ্ছে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করে দেবে। ড. কামাল হোসেনসহ অনেক সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কৃপাধন্য ব্যক্তিরা ততদিনে শেখ হাসিনা বিরোধী মঞ্চ তৈরি করে ফেলেছেন। নাম দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ সংলাপের পর সিদ্ধান্ত হলো বিএনপিসহ তাদের সব মিত্ররা নির্বাচন করবেন এবং নেতৃত্ব দেবেন ড. কামাল হোসেন। সব বিচারেই এখন ড. কামাল হোসেন বিএনপির অঘোষিত চেয়ারপারসন। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলো। বিভিন্ন দলের মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু হলো। বিএনপি কর্মীরা এই উপলক্ষে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হলো। প্রথম দু’দিন শান্তিপূর্ণভাবে মনোনয়নপত্র বিলি হলেও তৃতীয় দিন কোনও উসকানি ছাড়া বিএনপির লাঠিয়াল বাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর ওপর সংঘবদ্ধভাবে চড়াও হলো। এর জন্য তারা আগে হতেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। গাড়িতে আগুন দেওয়ার জন্য পেট্রোলের মজুত ছিল যথেষ্ট। পুলিশের দুটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হলো। ভাঙচুর করা হলো আরও কয়েকটি। ডজন খানেক পুলিশ সদস্যকে আহত করে হাসপাতালে পাঠানো হলো। মনে হচ্ছে বিএনপি তাদের ২০১৩-১৫ সালের তাণ্ডব সৃষ্টির জামানায় ফিরে গেছে। সাধারণ মানুষ মনে করেছিল যেহেতু বিএনপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তাদের আচরণগত কিছু পরিবর্তন হলেও হতে পারে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ হতাশ হয়ে দেখলো বিএনপি তাদের পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে। সন্ত্রাস ছাড়া তাদের অন্য কোনও ভাষা নেই। মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে তাদের এসব কর্মকাণ্ড আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার একটা প্রয়াস। আর এসব অপকর্মের ভাগীদার হয়ে যাচ্ছেন ড. কামাল হোসেন। যারা নিত্যদিন ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক চরিত্র উদ্ধারে নিয়োজিত তারা কী এসব বিষয় কখনও ভেবে দেখেছেন? তবে অতীত যদি আগামী দিনের দর্পণ হয় তাহলে বলা যায় নয়াপল্টনের সাম্প্রতিক তাণ্ডব নির্বাচনের আগে শেষ তাণ্ডব নয়। সতর্ক না হলে এই ধরনের ঘটনা আরও হবে বলে বিশ্লষকরা মনে করেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সাহায্য করা এখন বিএনপির জন্য অপরিহার্য।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক।