‘বলো কে জিতল তবে জন্মভূমি?’

প্রভাষ আমিনজাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পথপরিক্রমায় এর উদ্যোক্তারা বারবার বলে আসছিলেন স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে কোনও ঐক্য হবে না। সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যে যুক্ত হতে বিএনপিকে প্রাথমিকভাবে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার শর্ত দেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে ছিল বিকল্পধারা। তাদের চাপাচাপিতেই ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রাথমিক ঘোষণাপত্রে ‘প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য না করার’ সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল। কিন্তু সে ঘোষণা বাস্তবায়ন করা যায়নি। বরং স্বাধীনতা বিরোধীদের ব্যাপারে নিজেদের অনড় অবস্থানের কারণে কৌশলে বিকল্পধারাকে ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়া হয়। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বিকল্পধারা তাদের ভাঙাচোরা যুক্তফ্রন্ট নিয়ে সরকারি দলের মহাজোটে জুটে যায়।
এটা ঠিক, ঐক্যফ্রন্ট অন্তর্ভুক্ত দলগুলোর মধ্যে বিএনপি ছাড়া বাকি চারটি দলই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি। ঐক্যফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত সর্বশেষ দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরদের বীর। তার সাহসিকতা রীতিমতো রূপকথার অংশ। জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীর উত্তম’ পাওয়া একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি সম্ভবত কাদের সিদ্দিকী। জেএসডি সভাপতি আ স ম আব্দুর রব মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের একজন। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর ‘চার খলিফা’ হিসেবে পরিচিত চার ছাত্রনেতার অন্যতম আ স ম রব স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলনকারী। নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাও সারা জীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে আসছেন। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও বীর মুক্তিযোদ্ধা। ঐক্যফ্রন্টের মূলনেতা ড. কামাল হোসেনের একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। সম্ভবত সাহসের অভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। তবে মনেপ্রাণে তিনি বাংলাদেশের পক্ষের মানুষ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাথে বাংলাদেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনের লড়াইয়ে শামিল হন। তার নেতৃত্বেই বিজয়ের এক বছরেরও কম সময়ে প্রণীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান, যেটা বিশ্বের অন্যতম সেরা হিসেবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু সরকারের আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল পরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম এবং নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এখনও সাধারণভাবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতেই। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের যে দলগুলোর কথা বললাম তারা সবাই এখন আওয়ামী বিরোধী শিবিরে। আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। আওয়ামী লীগ বিরোধী হলেই তিনি স্বাধীনতাবিরোধী হবেন, এমন সরলীকরণে আমি বিশ্বাসী নই। বরং গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের দলই মনে করি। এই দলগুলোর নেতাদের দেশপ্রেম নিয়ে আমার কোনও সংশয় নেই। তবে স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে ঐক্য নয়, এই অবস্থানে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে টিকে থাকতে পারেননি। ঐক্যফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকেও বাকি দলগুলোর মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির কাতারে ফেলতে পারলে আমার ভালো লাগতো, আসলে ফেলাই উচিত ছিল। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানও একজন বীর মুত্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বোচ্চ খেতাবের ‘বীর উত্তম’ অর্জন করেছেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে দারুণ আলোড়ন তুলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসনের দায়ও অনেকটাই জিয়াউর রহমানের। তার প্রধানমন্ত্রীর শাহ আজিজুর রহমান চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। যুদ্ধাপরাধের দায়ে পরে এই তিনজনেরই ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। কর্মদোষে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল আজ স্বাধীনতাবিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিচ্ছে। বিএনপির সামনে সুযোগ ছিল এই দায় মুছে দেওয়ার। ড. কামালদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি ঘোষণা করে ঐক্যফ্রন্টে যুক্ত হতে পারতো। কিন্তু সেটা না করে তারা উল্টো ঐক্যফ্রন্টকে বুঝিয়ে জামায়াতকে রেখেই জোট করে ফেলে। বিএনপির এক হাতে জামায়াতসহ ২০ দল, আরেক হাতে ঐক্যফ্রন্ট। মির্জা ফখরুল অ্যাক্রোবেটিক নৈপুণ্যে আর দারুণ দক্ষতায় ভারসাম্যের খেলা খেলে গেছেন। বিএনপি ২৯৮ আসনে ‘ধানের শীষ’ বিলি করেছে। তার মধ্যে নিজেদের জন্য রেখেছে ২৪১ আসন। বাকি আসনগুলোর মধ্যে ৩৮টি পেয়েছে ২০ দল আর ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে তার অর্ধেক ১৯টি। ২০ দল বিএনপির অনেক পুরনো মিত্র। তাদের দলের সংখ্যাও বেশি। তাই তারা বেশি আসন পেতেই পারে। কিন্তু এই ৩৮টির মধ্যে ২২টিই জামায়াতের। যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াত এখন বিএনপির আশ্রয়ে টিকে আছে। নিজেদের নাম ও প্রতীক হারিয়ে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত এখন বিএনপির নামে এবং প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের দল চাইলে এই সুযোগে জামায়াতের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিতে পারতো। সেটা তো করেইনি, বরং সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে। জামায়াত একাই যেখানে ২২ আসন পেয়েছে, সেখানে ঐক্যফ্রন্টের সবাই মিলে পেয়েছে ১৯টি। অথচ এই ঐক্যফ্রন্ট রাজনৈতিক আইসিইউ থেকে বিএনপি মাঠে নামিয়েছে, সম্মানজনকভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলের নানামুখী চাপ থেকে বুকে আগলে রক্ষা করেছে। সেই ঐক্যফ্রন্ট যখন আসনের জন্য মির্জা ফখরুলের পেছনে পেছনে ঘোরে, দেখলে মায়াই লাগে। এটা ঠিক জামায়াতের ভোট আছে, ভাবমূর্তি নেই; আবার ঐক্যফ্রন্টের ভাবমূর্তি আছে, ভোট নেই।  ক’দিন আগেও বিএনপি ভাবমূর্তির জন্য লালায়িত ছিল। এখন গায়ে হাওয়া লাগতেই ভাবমূর্তি পায়ে দলে ভোটের হিসাবে চলে গেছে। ঐক্যফ্রন্ট বা গণফোরামের দাম কমে গেছে।

ড. কামাল হোসেনরা শুরু থেকে বলছেন, কোনও দলকে ক্ষমতা থেকে সরাতে নয়; তাদের আন্দোলন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের, সুশাসন প্রতিষ্ঠার। কিন্তু এটা করতে গিয়ে পুনর্বাসিত হচ্ছে বিএনপি। তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু বিএনপির পাশাপাশি নতুন জীবন পাচ্ছে লাইফ সাপোর্টে থাকা জামায়াতও। অথচ ঐক্যফ্রন্ট একটু অনড় থাকলে এবারই বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে জামায়াত নামের বিষবৃক্ষটি উপড়ে ফেলা যেতো। ঐক্যফ্রন্টের আন্দোলন হতে পারতো একইসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং স্বাধীনতাবিরোধীমুক্ত দেশ গড়ার। তেমন হলে রাজনীতিতে একটা ভিন্ন মেরুকরণ হতে পারতো। ড. কামালরা সেটা পারেননি। এখন যে ড. কামাল দেশজুড়ে নির্বাচনি প্রচারণা চালাবেন, ধানের শীষের পক্ষে ভোট চাইবেন; তখন কি তিনি বলতে পারবেন, জামায়াতের ২২ আসন ছাড়া ভোট দিন। জামায়াতের প্রার্থীদের জেতানোর দায়িত্বও কিন্তু ড. কামালেরই।

জামায়াত পেয়েছে ২২ আসন আর ঐক্যফ্রন্টের চার ত্রাণকর্তা মিলে পেয়েছে ১৯টি। প্রাসঙ্গিক কিনা জানি না, এই অঙ্কের পর আমার মাথায় খালি সুমনের একটা গান বাজছে,

‘যদি ভাবো কিনছো আমায় ভুল ভেবেছ,

কেনা যায় কণ্ঠ আমার দফা দফা

রুজি রোজগারের জন্য করছি রফা।

দু'হাতের আঙুলগুলো কিনতে পারো,

আপসেও নেই আপত্তি নেই আমারও।

আমাকে না আমার আপস কিনছো তুমি,

বলো কে জিতল তবে জন্মভূমি জন্মভূমি...।'

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ