আমরা ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে গত কয়েকদিনে দেখতে পেলাম, ভোটের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে তো বটেই, ভাঙা হয়েছে ক্যামেরা, গাড়িও। ভোটের মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক বিভিন্ন দল। একপক্ষের সঙ্গে অন্যপক্ষের সহিংসতা হোক, সেটা আমরা দেখতে চাই না। চাই ভোটের মাঠ উৎসবের থাকুক। রণক্ষেত্র দেখতে চাই না আমরা। কিন্তু তারপরও সহিষ্ণুতার ঘাটতির জন্য দুইপক্ষের মধ্যে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ভোটের মাঠে উত্তেজনা ছড়ায়। পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটে প্রাণহানিও। এই দৃশ্য এবারও অনুপস্থিত নয়। তবে এমন দৃশ্য ধারণ করতে গিয়েই রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীদের। ভোটের বাকি দিনগুলোতে এই আচরণ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা গণমাধ্যমকর্মীদের।
রাজনৈতিক দলের কর্মীরা মাঠে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলা করছে, এটা দৃশ্যমান। দৃশ্যের আড়ালেও অনেক ঘটনা ঘটে থাকে। ফোনে বা ডেকে নিয়ে হুমকি দেওয়ারও অভিযোগ আছে মাঠের গণমাধ্যমকর্মীদের। কাকে কম দেখানো হলো টিভিতে, পত্রিকায় কম লেখা হলো, এসব নিয়েও অভিযোগ আছে। ভোটের প্রার্থীরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্যিকভাবে প্রভাবশালী বলে গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকিও দিয়ে যাচ্ছেন বলে অনেকের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
ভোটের পরে দেখে নেওয়ার হুমকি তো বরাবর থাকেই। এবারও এতসব হুমকি নিয়েই গণমাধ্যমকর্মীরা মাঠে আছেন। ‘খামোশ’-এর মতো বোমারু ধমক খেয়েও যৌক্তিক প্রশ্ন করতে বুক কাঁপছে না তাদের। বরং সাহস নিয়ে আরও জোরালো প্রশ্ন করছেন তারা। শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার পরেও পেশাগত দায়িত্ব থেকে সরছে না কেউই। কারণ, আমরা জানি ভোটের ফলের পর একটি বড় অংশ পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরে আসবেন এই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেই। যারা জয়ী হবেন, তারা সাময়িক অহংবোধের চূড়ায় উঠে বসবেন। কিন্তু সেই পাহাড়ের ধস ঠেকাতে তারাও গণমাধ্যমকর্মীদেরই পাশে চাইবেন। এই প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যমকর্মীরা অভ্যস্ত। তবে, আগে যেমন করে গণমাধ্যমকর্মীরা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন, রাজনৈতিককর্মীরা যেমন সমীহ করতেন, সেই বাস্তবতা থেকে আমরা এখন অনেক দূরে। এই হাওয়া বদলের প্রথম কারণ–গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও কর্মীরা কোনও কোনও রাজনৈতিক দলকে নিকট আত্মীয় ভাবতে শুরু করেছে। দ্বিতীয়, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এই ব্যবসায়ীরাই আবার গণমাধ্যমে পুঁজির জোগানদাতা। তৃতীয়ত, পেশার গুণগত মানও কমেছে খানিকটা। ফলে মাঠের পেশাগত লড়াইয়ে গণমাধ্যমকর্মী কখনও কখনও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক নেতা ও দলের জন্য অশনিসংকেত হলো–তারা যে ভোটের খেলায় নেমেছেন, তা কতটা ‘পরিচ্ছন্ন খেলা’ হলো, সেই রায় কিন্তু এই নিঃসঙ্গ শেরপারাই দেবেন। তাদের রায়ই মেনে নেবেন জনমানুষ। অতীতেও যেমন নিয়েছেন। অতএব-ভোটের মাঠে গণমাধ্যমকর্মীকে প্রতিপক্ষ ভাববেন না। আমরা উৎসবের খবর কুড়োতে যাই। আপনারা উৎসবকে রণক্ষেত্র বানাবেন, সেই দায় কেন আমাদের হবে?
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি