বিএনপি যে তিনবার ক্ষমতায় এসেছিল তার কোনোটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য ভালো কিছু রেখে যায়নি। দুর্নীতি, হত্যা, দখলবাজির ইতিহাসে পরিপূর্ণ বিএনপির ইতিহাস। বেগম খালেদা জিয়া ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে বেশি ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হলেও বিদায় নিয়েছিলেন নেতিবাচক ফলাফলে। এরপর আবারও ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তাদের সরকার আমলের দুর্নীতি, হত্যা, জঙ্গিবাদের উত্থান, ২১ আগস্ট- এসব মানুষ ভুলে যায়নি। আর তাই ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিরাট ব্যবধানে হেরে যায় বিএনপি।
২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে ভেবেছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বিরাট বেকায়দায় ফেলে দিতে পারবে। অথচ বাংলাদেশের এবং গোটা বিশ্বের জনগণ দেখলো বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। গোটা দেশে যে পেট্রোলবোমা মেরে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে মারলো, সে ঘটনা এখনও মানুষের স্মৃতিতে তাজা আছে। আগুনে পোড়া মানুষগুলো এখনও কত কষ্ট করে বেঁচে আছে। এই ক্ষত শুধু শরীরে নয়, তাদের হৃদয়েও দগদগে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয় তার ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাসে। এই দুই দলের মধ্যে যে একটি গুণগত পার্থক্য আছে সে কথা কেউ সামান্য মাথা খাটালেই বুঝতে পারবেন। যে দলটির জন্ম না হলে আজকে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না, যে নেতার জন্ম না হলে আজকে আমরা জাতির পিতা পেতাম না, জয় বাংলা স্লোগান পেতাম না- সেই দলটি বারেবারেই এই বাংলার বুকে উদ্ধারকর্তা হয়েই সামনে এসেছে। বিএনপি জামায়াতের শাসনামলের খতিয়ানকে ভুলে গেলে অন্যায় হবে। তারেক জিয়া অ্যান্ড গংদের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা পাচার কেমন করে ভুলে যেতে পারি আমরা? বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। প্রশাসনের চূড়ান্ত দলীয়করণ করে সব জায়গাতেই নিজেদের লোকদের সেট করে রেখে গেছে। ভুলে গেলে চলবে না যে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ একটা বড় সময়কাল। এই এত বছরে ক্ষমতায় ছিল কেবল স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দোসরেরা, যারা এদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, অর্থনৈতিক মুক্তিকে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের যে মূলনীতি ছিল তার একটিকেও ধারণ করেনি তারা। উল্টো সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে প্রশাসনের দলীয়করণের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রকারীদের সেট করে রেখে গেছে ক্ষমতার আনাচে কানাচে। এত বছরের কালো অধ্যায় মুছে দিতে হলে প্রয়োজন এই শক্তিকে ক্ষমতার বাইরে রাখা।
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। ১৯৭১ সালের এক ডিসেম্বরের আমরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলাম পাকিস্তানি ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের হাত থেকে। সেই একই ডিসেম্বরে আমাদের সামনে সুযোগ এসেছে এদেশ থেকে ৭১'র পরাজিত শক্তিতে আবারও পরাজিত করার। এই সুযোগ আমরা অবহেলা করতে পারি না।
ভোটের লড়াই শুরু হয়েছে। শীতের এই মিষ্টি আমেজে সারা দেশেই চলছে ভোট চাওয়ার মহড়া। কিন্তু বিএনপির নমিনেশন বাণিজ্যের কাহিনি তাদের নিজেদের দলের লোকদের মুখেই প্রচারিত হচ্ছে। প্রচারণায় মনোযোগী না হলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য কেঁদে বেড়ানো বিএনপির লোকেরা বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের লোকদের ওপর, যার ফলে কয়েকজনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের কাহিনি এখন চারদিকে আলোচনার বিষয়। লন্ডনে বসে যিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন তিনি একজন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধী। মাথায় জেল, ফাঁসির হুকুম নিয়ে পালিয়ে থাকা একজন ব্যক্তি যে দলের নির্বাচনি কৌশল নির্ধারণ করে দেয় সেই দলের নৈতিকতা কোন পর্যায়ে থাকতে পারে সে বোঝার জন্য খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না।
আফসোস হয় সেই দলের নেতাকর্মীদের জন্য। একটি দলের সবাই তো আর দুর্নীতিবাজ হয় না। প্রচুর নেতাকর্মী আছেন যারা সৎ ও ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনীতি করতে এসেছিলেন এবং এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে অত্যন্ত শক্তভাবে মাঠে ফিরতে চেয়েছিলেন। বিএনপির সামনে সেই সুযোগও ছিল যদি জামায়াতকে ছাড়তে পারতো। তা না করে বিএনপি আবারও একই ভুল করলো। নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়া স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীকে তারা নিজেদের মাঝে বিলীন করে নিলেন। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের কারণ ছিল তাদের দলীয় নীতিমালা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অর্থাৎ বলা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানই তারা মানে না। তাহলে কীভাবে কিংবা কোন নৈতিক অবস্থান থেকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবারের নির্বাচন করছে? যদিও তাদের বক্তব্য হলো, দলকে নিয়ে নয়, ব্যক্তিকে নমিনেশন দিয়েছে। প্রশ্নটা হলো- সেই ব্যক্তি তো দলীয় আদর্শের বাইরের লোক নয়। তারা তো জামায়াতের আদর্শকে অস্বীকার করে নির্বাচনে আসেনি। এছাড়াও দেখা গেছে বিএনপি প্রার্থীদের অনেকেই চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের আত্মীয় বা বংশধর।
বিএনপি যদি বাংলাদেশকে ধারণ করতো, যদি তারা স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দল হতো এবং যদি তারা সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের দল হতো তাহলে এবারের নির্বাচনই ছিল সেই রাস্তা যেখানে তারা অতীতের ভুলকে স্বীকার করে জামায়াতের মতো একটি ঘৃণ্য দলকে ত্যাজ্য করে মূল ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারতো। যদি পারতো তবেই হয়তো একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের রাজনীতি আশা করা যেত, যেখানে লড়াই হতো সমানে সমান। পারলো না বিএনপি। তারা বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সুরটাই ধরতে পারলো না। প্রায় আড়াই কোটি তরুণ ও নতুন ভোটারের প্রাণের দাবিকে তারা উপেক্ষা করলো।
স্বাধীন এই বাংলাদেশে যারাই রাজনীতি করবে তাদের কথা বলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির ভাষায়। যেখানে বলা আছে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গঠনের কথা। আর এই একটি জায়গাতেই বিএনপি রয়েছে ঠিক বিপরীত দিকে মুখ করে। কারণ, তারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে পারছে না যে তারাও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ চায় এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করতে চায়। একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ে পাকিস্তানের সাথী ছিল সেই জামায়াতকে স্বাধীন বাংলাদেশে সঙ্গী করে কখনও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এ সত্যটি যখন শরতের আকাশের মতো ভোটারদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে তখন বিএনপিও জানে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের যোদ্ধা আর হতে পারলো না তারা। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ নয় কেবল, গোটা বিশ্বের জনতা বুঝে গেছে আগামীর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কে হতে পারে যোগ্য নেতা আর কার হাতে নিরাপদ এই বাংলাদেশ। বিজয়ের মাসে ৭১-এর পরাজিত শক্তির পরাজয় তাই সময়ের ফের মাত্র।
লেখক: কলামিস্ট