আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ২৮ বছরের মধ্যে। বয়সের হিসাবে এরা সবাই ভোটার। এই সময়ের তরুণরা বেশ মেধাবী, দক্ষ ও দেশের কর্মক্ষম ভবিষ্যৎ। তারা এতটাই মেধাবী যে, ভালো-মন্দ, আলো-অন্ধকারের তফাৎ বেশ সহজেই ধরতে পারে, হয়তো তারা প্রকাশ করে না বা তাদের প্রকাশ করার ভঙ্গি ভিন্ন। কিন্তু তাদের ভাবনায় সেই বিবেচনা রেখে দেয়। এই ২২ শতাংশের প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ তরুণ এবারই প্রথম ভোট দেবে। তাদের ভাবনায় তারা কোন দল বা প্রতীককে বেছে নেবে, সেটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। যেহেতু আমি তারুণ্য নিয়ে কাজ করি, তাই এই লেখায় তাদের কিছু ভাবনা তুলে ধরতে চাই।
প্রথমত, আমাদের দেশের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে সমর্থন করে। যেহেতু তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তাই তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে আবেগ-অনুভূতির সংমিশ্রণ, মুক্তিযুদ্ধ মানে বিশাল গৌরবমাখা অর্জন, মুক্তিযুদ্ধ মানে একটা বড় উপলব্ধি। যে উপলব্ধি থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধা ও এর পক্ষের শক্তিকে সবসময় সমর্থন দিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি তথা মানবতাবিরোধী অপরাধী এবং তাদের দোসরদের তারা ভয়ানক ঘৃণা করে। এই বিষয়টা একদমই সরল। এইখানে কোনও জটিল সমীকরণ নেই।
আন্তর্জাতিক এক গবেষণা বলছে, এই প্রজন্ম অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর আর তারা নিজেদের অনেক বেশি বৈশ্বিক নাগরিক মনে করে। তারা একইসঙ্গে দেশের খোঁজখবর যেমন রাখে, তেমনি বহির্বিশ্বে কী হচ্ছে, তারও খোঁজখবর রাখে। দেশের দুই দলের মধ্যেকার কাদা ছোড়াছুড়ি তারা একদমই পছন্দ করে না। তারা নতুনত্ব চায়, যে নতুনত্ব তাদের বুঝবে, তাদের মনস্তত্ত্ব জানবে।
আমাদের তরুণদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা উদ্যমী, কর্মক্ষম প্রার্থীকে যেমন প্রথম বিচারে রাখে, তেমনি সমাধান হওয়ার মতো বিষয়, যা সমাধান হয়নি তা নিয়ে খুবই বিব্রত।
আমাদের দেশে মোট এগারো ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। এই এগারো ধারার শিক্ষাব্যবস্থার কার্যক্রম নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি চোখে পড়ার মতো।
২.
তিনটি খাতকে তরুণরা সবচেয়ে অবহেলিত খাত হিসেবে আখ্যায়িত করছে। শিক্ষা, যোগাযোগ ও চিকিৎসা। হেফাজতের মতো একটা ধর্মান্ধ দলের প্রস্তাবে পাঠ্যবইয়ের তালিকা পরিবর্তিত হওয়ার বিষয়টি তাদের খুবই পীড়া দিয়েছে। তাদের ভাবনা, হেফাজত কেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে? আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কেন এই অন্যায় আবদার মেনে নেবে?
চিকিৎসা খাতের উন্নয়নে তাদের ভাবনা ভিন্ন। বড় বড় শহরে যেভাবে প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক বেড়েছে, এ জন্য তারা সরকারি হাসপাতালগুলোতে সঠিক সেবা না পাওয়ার কারণকে দায়ী করছে। তাদের ভাবনা, এখন কেউ রোগে আক্রান্ত হলেই প্রাইভেট হাসপাতালে দৌড়াচ্ছে। এর কারণ কী? এর কারণ হলো, সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার না থাকা এবং সময়মতো সঠিক সেবা না পাওয়া।
আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে সরকারি চাকরি করার প্রতি আগ্রহী করে তোলা হচ্ছে। এর কারণ হলো, আমাদের অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় কাউকে উদ্যোক্তা হওয়ার কথা শেখানো হয় না। কারণ উদ্যোক্তার পথ স্বতন্ত্র। উদ্যোক্তা কারও অধীনস্ত হয়ে থাকে না। একজন উদ্যোক্তা নিজের মেধা, দক্ষতায় নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয়। তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় শেখানো হয় সরকারি চাকরি পাওয়ার কথা। কারণ, সরকারি চাকরি যারা করবেন, তারা আজীবন সরকারের অধীনস্ত হয়ে থাকবেন। একজন সরকারি চাকরিজীবীর স্বাতন্ত্র্য নেই। আর সরকারি চাকরিতে এমনভাবে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা অন্যকোনও প্রাইভেট চাকরিতে নেই।
সর্বশেষ ৪০তম বিসিএসে ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন তরুণ আবেদন করেছে। এই বিশাল সংখ্যক আবেদনই বলে দেয় শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের পরিমাণ কত বড় সংখ্যক।
সম্প্রতি প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ থেকে জানা যায়, সারা দেশে প্রায় ২৭ লাখ তরুণ বেকার। এদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা, যাদের কেউই চাকরি পাচ্ছে না। এই বিশাল অঙ্কের বেকারদের মধ্যে ৩৯ শতাংশই শিক্ষিত বেকার।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। মাত্র সাত বছরে বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আর উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারের হার বেশি।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই সময়ের তরুণ-তরুণীদের আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে। প্রতিদিন আত্মহত্যা করছে তিন হাজার মানুষ। বাংলাদেশ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাবে, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের সঠিক চাকরি না পাওয়াও আত্মহত্যার বড় কারণ।
আমাদের তরুণরা আরেকটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে তা হলো, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। তাদের ভাবনায় সড়ক দুর্ঘটনায় অভিযুক্ত এমন কোনও চালককে যদি আমরা কঠিন শাস্তি দিতাম, তবে আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বন্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু তা হচ্ছে না। কারণ দেশের বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা পরিবহন শ্রমিকদের মদদ দিয়ে যাচ্ছেন।
যোগাযোগ খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার কারণে রাজীব হোসেন, আবদুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মিমের মৃত্যুর ঘটনা সারা বিশ্ববাসী দেখেছে। এরপরও এই যোগাযোগখাতকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। শুধু তাই নয়, পরিবহন শ্রমিকদের অপরিকল্পিত ধর্মঘটের কারণে সারাদেশের মানুষের দুর্ভোগে পড়ার ঘটনা তরুণরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে।
৩.
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন। এরমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি হচ্ছে তরুণ ভোটার। এই বিশাল সংখ্যক তরুণ ভোটারই একসময় আগামীর তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করবে। কোনও কারণে যদি তাদের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিরক্তি জন্মে যায়, তবে তাদের আর কখনও ভোটকেন্দ্রে নেওয়া যাবে না। সুতরাং তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দেখার কোনও সুযোগ নেই।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
benoydutta.writer@gmail.com