একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নানা কারণে ব্যাপক আলোচিত ছিল। এসব কারণের অন্যতম হলো– এক. কিছু মুক্তিযোদ্ধা নিজেরাই মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির দায়ে অভিযুক্ত বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করেছেন।
দুই. বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কামাল হোসেন যিনি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে, জাতির বিবেক হিসেবে থাকার কথা, তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কথা বলে এমন দলের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, যাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, অগণতান্ত্রিক আচরণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি নিজেই সোচ্চার ছিলেন। কামাল হোসেন দাবি করেছেন বিএনপি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের প্রার্থী করবে জানলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অংশ হতেন না। অন্যদিকে, একথা জানার পরও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিন তা করেননি। ফলে অনেকেই মনে করেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার বা কিংবা শুধুমাত্র শেখ হাসিনার প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহার কারণে ড. কামালের এ স্ববিরোধী অবস্থান তা কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর পেছনে ড. কামাল হোসেনের অন্য কোনও গোপন এজেন্ডা রয়েছে, যা সহজেই অনুমেয়।
তিন. নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের তৎপরতা বিশেষ করে বিএনপির শীর্ষনেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও বিএনপিপন্থী সাংবাদিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে আইএসআইয়ের এজেন্টের কথোপকথন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানের শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ বাংলাদেশের ব্যাপারে পাকিস্তানের অতি আগ্রহেরই জানান দেয়। এত বছর পরও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এত ভয়ঙ্কর বিদ্বেষ এবং বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দলের বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হওয়া দুর্ভাগ্যজনক। টেলিফোন কথোপকথনে আইএসআইয়ের এজেন্ট মেহমুদ ভবিষ্যতে বড় খেলার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ বড় খেলা যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বড় হুমকি তা বোধ করি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। বড় খেলা কী হতে পারে? বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে কনফেডারেশন গঠন করার পাকিস্তানি স্বপ্ন বাস্তবায়ন। তা যদি সম্ভব না হয় পাকিস্তানপন্থী সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে বাংলাদেশকে ‘বাংলাস্তান’ তথা আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করা। তা-ও যদি সম্ভব না হয় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করা।
চার. তথাকথিত সুশীল ও একটি পশ্চিমা রাষ্ট্রের সরাসরি প্রযোজনা ও তত্ত্বাবধানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন থেকে শুরু করে নির্বাচনে সুশীল ও পশ্চিমা রাষ্ট্রটির দূতাবাসের দৌড়ঝাঁপ ও হস্তক্ষেপের সুস্পষ্ট চেষ্টাও পরিলক্ষিত হয়েছে।
এসব বিবেচনায় এবারের নির্বাচন ছিল স্বাধীনতা রক্ষা বনাম স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়ার নির্বাচন। মুক্তিযুদ্ধের সাহসে বলীয়ান বাংলাদেশের জনগণ সব ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিকে বেছে নিতে ভুল করেননি। এবার জনগণের বিশ্বাসের, সাহসের মর্যাদা রক্ষার পালা বিজয়ীদের। আমজনতা হিসাবে বিজয়ীদের প্রতি আমার কয়েকটি অনুরোধ–
এক. বিজিত প্রতিপক্ষের এক বিন্দু রক্তপাতও যাতে না হয় সে জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে শান্তিপ্রিয় বাঙালি একবেলা কম খেয়ে থাকতে রাজি আছে, কিন্তু অশান্তি পছন্দ করে না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০১-এর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা মানুষ মনে রেখেছিল এবং পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফলে তার সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলিক্ষিত হয়েছে। যারা হত্যা, সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রতিশোধ নয়।
দুই. বড় খেলা মোকাবিলা করতে মান-অভিমান ভুলে মুক্তিযুদ্ধের শক্তির মধ্যে আরও বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ।
তিন. দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স মানে জিরো টলারেন্স। কোনও ব্যত্যয় নয়। সে যেই হোক।
চার. দ্রুত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের চাকরির ব্যবস্থা করা।
পাঁচ. শিক্ষার মানোন্নয়নে ও গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ।
ছয়. ব্লু ইকোনমির সুযোগ নিতে ও আমাদের সমুদ্রের অপার সম্পদ আহরণে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজস্ব জনবল ও অবকাঠামো প্রস্তুত করা।
সাত. দারিদ্র্য বিমোচনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি হতদরিদ্র মানুষের জন্য বছরব্যাপী নামমাত্র মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
আট. সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো।
নয়. আওয়ামী লীগের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বিরোধিতার অভিযোগ তুলেছে বিএনপি। এ বিষয়ে তদন্ত করে সঠিক তথ্য জাতির সামনে তুলে ধরা।
দশ. বিগত সময়ে যে ভুলগুলো হয়েছে তার সংশোধন ও পুনরাবৃত্তিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠনের নেতাকর্মীদের আচরণকে কঠোর নজরদারিতে রাখা যাতে, তারা নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারে। তারপরও এমন কোনও ঘটনা ঘটলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ত্বরিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
বিজয়ের মাসে বিজয়ীর বেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির প্রত্যাবর্তনে জনগণ তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। এবার প্রতিশ্রুতি পূরণের পালা সরকারের।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: zhossain@justice.com