বিরোধী দলের খোঁজে মরিয়া আওয়ামী লীগ!

প্রভাষ আমিনকিছুক্ষণ আগে শেরেবাংলা নগরের সুরম্য সংসদ ভবনে বসেছে একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। একাদশ সংসদ নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব আশা, আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা আছে, তেমনটি বলা যাবে না। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের পরই বোঝা গেছে একাদশ সংসদ হবে নিরুত্তাপ, একপেশে ও ভারসাম্যহীন। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ৮ সদস্য শপথ না নেওয়ায় সংসদের সম্ভাব্য উত্তাপ আরও  কমে গেছে। তবে অধিবেশনের শুরুতেই স্পিকার-ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন হয়েছে। পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী ও ফজলে রাব্বী মিয়া। রাষ্ট্রপতির ভাষণসহ অন্যান্য নিয়মিত কার্যক্রমও হয়েছে।
তবে কার্যকর বিরোধী দলবিহীন সংসদ নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব বেশি আগ্রহ নেই। তাই আওয়ামী লীগ এখন কৃত্রিম উত্তাপ তৈরির চেষ্টা করছে, মরিয়া হয়ে খুঁজছে বিরোধী দল। এটা ঠিক, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটের জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। অধিকাংশ জরিপেই আওয়ামী লীগের জয়ের পূর্বাভাস ছিল। তবে জরিপের ফল দেখেই আওয়ামী লীগের জয়কে আমি অবশ্যম্ভাবী মনে করিনি। বরং বাংলাদেশের রাজনীতির ধারায় উল্টোটাই হওয়ার কথা। যত ভালো কাজই করুক, ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষেই ভোট দিতে পছন্দ করেন মানুষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই প্রবণতাকে পাল্টে দিয়ে টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও আবার জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করে। তবে আওয়ামী লীগের জয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলার মূল কৃতিত্ব বা দায় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের। নির্বাচনের আগে তাদের প্রস্তুতি, চাল-চলন, কথাবার্তা, ইশতেহার- সবকিছু দেখে আমার মনে হয়নি তারা জিততে চান। অভিযোগ করতে তারা যত ব্যস্ত ছিল, জয়ের ব্যাপারে তত সিরিয়াস মনে হয়নি। নির্বাচনের অনেক আগেই আসলে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছিল, মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল। তবে আওয়ামী লীগের এই অবশ্যম্ভাবী জয় আসে অবিশ্বাস্য ফলাফল নিয়ে।

আওয়ামী লীগ জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী ছিল। তবে আওয়ামী লীগের কেউও ভাবেনি তাদের জোট ২৮৯ আসন পাবে বা বিএনপির মতো দল মাত্র ৬টি আসন পাবে। আসনের চেয়েও অবিশ্বাস্য ছিল ভোটের ব্যবধান। কারণ, বেশি ভোট পেয়েও কম আসন পেয়ে বিরোধী দলে বসার তিক্ত অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগেরই আছে। তবে এবার ভোটের ব্যবধান হয়েছে অবিশ্বাস্য। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভোট যেখানে লাখের ঘরে, বিএনপির ভোট সেখানে শ’ বা হাজারের ঘরে। আওয়ামী লীগের জয় পূর্ব অনুমিত হলেও আসন ও ভোটের ব্যবধান তাকে অবিশ্বাস্য করে তুলেছে। এবারের নির্বাচনটি ‘ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার’ প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে। পুলিশ বা প্রশাসন বা দলের অতি উৎসাহী কর্মীরা আওয়ামী লীগের অবধারিত জয়কেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নির্বাচনের এই অবিশ্বাস্য ফলাফলে বিএনপি মহলে যতটা শোকের ধাক্কা, আওয়ামী লীগ মহলে ততটাই অস্বস্তি। সেই অস্বস্তি কাটাতেই আওয়ামী লীগের সবাই বারবার বিএনপির পরাজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করছেন। বিএনপি যে হারবে, এটা তারও জানতো। তবে বিএনপি গোটা পঞ্চাশেক আসন পেলে আর ভোটের ব্যবধান আরেকটু কম হলে এই নির্বাচন নিয়ে অত বড় প্রশ্ন উঠতো না। এক মাস পরও কিন্তু সবাই নির্বাচনি শক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এখনও চায়ের টেবিলে, টকশোতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থামেনি। তবে বিএনপির অভিযোগ যত লম্বা, তার পক্ষে যুক্তি ততটা শক্ত নয়। শুধু মুখের কথায় তো আর মামলা জেতা যাবে না।

নির্বাচনি ফলাফলে হতভম্ব বিএনপির ৬ সাংসদ শপথ নেননি, সংসদেও যাচ্ছেন না। ঐক্যফ্রন্টের দুই সাংসদও এখনও শপথ নেননি। তবে তারা বলে দিয়েছেন শপথ নিতে চান এবং জনরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সংসদেও যোগ দেবেন। তবে এখনও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়নি। শপথ নেওয়ার প্রশ্নে ঐক্যফ্রন্টের ৮ সাংসদের মধ্যে বিভক্তি এখন অনেকটাই স্পষ্ট। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। তাই আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা সংসদেও যেতে পারেন। ঐক্যফ্রন্টের ৮ সদস্যের ভয়েস জাতীয় পার্টির ২২ জনের চেয়েও জোরালো হবে। নির্বাচনের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে সংসদে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংসদে বিরোধীদের সংখ্যা নিতান্তই কম হলেও তাদের সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা হবে না। সংসদে যেকোনও সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব, আলোচনা ও সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।’ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার। বিরোধী দল সংসদে গিয়ে তাদের দাবি তুলে ধরতে পারে, নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগও সংসদে তুলে ধরতে পারবে। আর কথা বলার সুযোগ না পেলে ওয়াকআউট, বর্জন বা বয়কটের সুযোগ তো থাকছেই।

বিএনপি আসবে না ধরে নিয়েই কৌশল প্রণয়ন করছে আওয়ামী লীগ। সেক্ষেত্রে দশম সংসদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছে তারা। দশম সংসদে জাতীয় পার্টির অবস্থান ছিল অভূতপূর্ব। তারা একইসঙ্গে বিরোধী দল ছিল, আবার ছিল সরকারেও। এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। বারবার বিরোধী দল হতে চেয়ে কান্নাকাটি করেও তখন পুরোপুরি বিরোধী দল হতে পারেনি। তবে এবারও জাতীয় পার্টির অধিকাংশ সাংসদ গত সংসদের মতো সরকারেও থাকতে চেয়েছিলেন। তবে তারা জানিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা যা বলবেন, তা-ই করবেন। শেখ হাসিনা কী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, জানা যায়নি; তবে জাতীয় পার্টি এবার পুরোপুরি বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে। কারণ, তাদের কেউই মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে জিতে এখন সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা আইনগতভাবে ঠিক হতে পারে, তবে নৈতিকভাবে নয়। শুধু জাতীয় পার্টি নয়, এবার ১৪ দলের শরিকদের কেউও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের বিরোধী দলের আসনে বসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ১৪ দলের শরিকদের নৈতিক সমস্যাটা জাতীয় পার্টির চেয়েও বেশি। কারণ, মহাজোটের শরিক হলেও জাতীয় পার্টি নির্বাচন করেছে নিজেদের প্রতীক লাঙ্গলে। আর ১৪ দলের শরিকরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে নৌকা প্রতীকে। এখন নৌকা মার্কায় নির্বাচন করে কোন মুখে সরকারের সমালোচনা করবে। কিন্তু সরকারি দলের চাওয়াটা স্পষ্ট। তারা বিরোধী দলকে সংখ্যায় ভারি করতে চাইছে। জাতীয় পার্টির ২২ জনের সাথে ১৪ দলের ৮ জন, যুক্তফ্রন্টের ২ জনও বিরোধী দলের আসনেই বসবে। তবে সংখ্যাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোয়ানটিটির চেয়ে কোয়ালিটি গুরুত্বপূর্ণ। ঐক্যফ্রন্টের ৮ জন থাকলে যা হবে; জাতীয় পার্টি, ১৪ দল, যুক্তফ্রন্ট মিলেও তা হবে না। তাই সংসদকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত করতে চাই সত্যিকারের বিরোধী দল। আর সত্যিকারের বিরোধী দল হলো সরকারের সবচেয়ে বড় বন্ধু। বিরোধী দল সরকারের ভুল ধরিয়ে দেবে, সমালোচনা করবে। সেটা দেখে সরকার নিজেদের শুধরাবে। কিন্তু চারপাশে নিজেদের লোক রেখে এটা সম্ভব নয়। আর প্রকৃত বিরোধী দল ছাড়া সংসদ কার্যকর হয় না। এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের খোঁজে যতটা মরিয়া, নির্বাচনের আগে বিষয়টি মাথায় রাখলে ভালো হতো।

আমার বাসা ইকবাল রোডে। অফিস কাওরান বাজারে। প্রতিদিন আমাকে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে অফিসে আসতে হয়। সংসদ ভবনের তিনদিক ঘিরে রাখা কৃত্রিম জলাধারটি এখন শুকনো। সম্ভবত সংস্কার কাজের জন্য পানি সেচে ফেলা হয়েছে। তবে সত্যিকারের বিরোধী দলের অভাবে যেন সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারাটিও শুকিয়ে না যায়। সবচেয়ে ভালো হয় ঐক্যফ্রন্টের সাংসদরা শপথ নিয়ে সংসদে এলে। আর না হলে জাতীয় পার্টি, ১৪ দল, যুক্তফ্রন্টের সাংসদরা যেন সত্যিকার বিরোধী দল হয়ে ওঠে। তারা যেন সরকারের ভুল ধরিয়ে দিয়ে উন্নয়ন আর অগ্রগতিকে এগিয়ে নেয়।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ