সীমাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাস্তানি, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ আর দখলবাজি করে নাভিশ্বাস করে তুলেছিলো জনগণের জীবন। ফলাফল জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যান।
বাংলাদেশের রাজনীতির কাঠামো পাল্টাতে শুরু করেছিলো ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পটভূমি থেকেই। সারা বিশ্বের বাঙালিরা যখন ফুঁসে উঠেছিলো কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে, বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল সরাসরি বিরোধিতা করে বসলো গড়ে ওঠা সেই আন্দোলনকে। জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সন্ত্রাসী ও রাজাকারদের দলকে বাঁচাতে তারা বিলীন করে দিলো নিজেদের অস্তিত্বকে। কেবল তা-ই নয়, তারা দেশে বিদেশে এই বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত হিসাবে প্রমাণ করতে ওঠেপড়ে লেগেছিলো। শাহবাগের তরুণদের নিয়ে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছিলো বিএনপির রাজনৈতিক নেতারা আর তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীরা।
নিয়মতান্ত্রিক ও যৌক্তিক একটি আন্দোলনের মাঝে তারা স্বভাব মতো ধর্মকে ঢাল হিসাবে নিয়ে এসে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করলো। অথচ লাভ কিছু হয়েছিলো কি? হয়নি। তারা তাদের হীন উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলো জনগণের প্রতিরোধ আর শেখ হাসিনার সরকারের দৃঢ় প্রত্যয়ে। সেই ব্যর্থতারই ঘানি টেনে চলেছে আজও। অথচ সেদিনের সেই ভুলকে তারা মানতে রাজি নয়। মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীরাই সেদিন শাহবাগের যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলো কেবল মুক্তিযুদ্ধের ঋণ শোধ করার তাগিদ থেকে। অনেক কেন্দ্রীয় নেতারা ধীরে ধীরে সরে গেছেন দলের কাছ থেকে। বোধোদয় হয়নি দলটির। তারেক রহমানের রাহুগ্রাস থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে আর কোমর শক্ত করে দাঁড়াতে পারছে না দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি।
যদিও বিএনপির জন্মই হয়েছিলো একটি অরাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তারপরও এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে বাম প্রগতিশীল ধারাটির ক্রমাগত ব্যর্থতার সুযোগে এ দলটি তাদের পক্ষে জনসমর্থন আদায়ে সফল হয়েছিলো। নব্বইয়ের স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সর্বদলীয় আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়ার দলেরও একটি ভূমিকা ছিল। অথচ এ দলটি ভুলতে পারেনি তাদের পুরনো দোসর স্বাধীনতাবিরোধীচক্র জামায়াত শিবিরকে। জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া ঐতিহ্যকে আবারও বুকে টেনে নিলো খালেদা জিয়া। কেবল বুকেই টেনে নেয়নি, একে একে পোক্ত আসনে বসানোর সব রকম আয়োজনও করেছিলো। পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক জিয়া দলটির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে গণতান্ত্রিক চেহারাটি টেনে খুলে ফেলে দিলো। আফসোস, তারেক জিয়া ভেবেছিলো যুবরাজ হয়ে কেবল রাজ করেই যাবেন তিনি।
চাঁদাবাজ ও দখলবাজ তারেক রহমান ভুলে গিয়েছিলেন এটি বাংলাদেশ, সৌদি আরব নয়। এখানে জনগণের নেতার জায়গা আছে, কোনও যুবরাজের ঠাঁই হয় না। যে মাটিতে সূর্যসেন, প্রীতিলতা, আসাদ, জব্বার, শেখ মুজিবের মতো নেতাদের জন্ম হয় সেখানে তারেকের মতো একজন ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘দেশদ্রোহীর’ স্থান হতে পারে না। সঠিক জবাবটি পেয়েছে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই হয়তো দলটি অনেক কিছু বুঝতে পারতো। পরিবর্তিত বাংলাদেশের চেহারা যারা চিনতে পারে না বা চায় না তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, দেশের মানুষের কোনও কাজ হয় না। গত ১০ বছরে বিএনপির কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। ছিল কেবল সন্ত্রাস ও আগুন জ্বালানো কর্মসূচি। রাষ্ট্রীয় সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে যারা ভাবে না তাদের যে সাধারণ জনগণ আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে চায় না এ বার্তাটি যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ততই বেঁচে থাকার মতো শেষ খড়টুকু পাবে তারা। এরইমধ্যে প্রায় তিন দশক পর অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ডাকসু নির্বাচন। ডাকসু মানেই বাংলাদেশ আর ডাকসু মানেই আগামীর রাজনীতির ভবিষ্যৎ। ডাকসু আর বাংলাদেশের রাজনীতি যেন পরিপূরক। আর সে নির্বাচনেও ভরাডুবি ঘটেছে বিএনপির সহযোগী ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের। যে ছাত্রদল থেকে অনেকেই ছিল পূর্বের ডাকসুর নেতৃত্বে আর সেসব নেতাদের অনেকেই এখন বিএনপির সামনের সারির নেতা। হয়তো ক্রমেই চাকসু, রাকসুসহ আরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনুষ্ঠিত হবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ডাকসুর ফলাফলকেও কি তারা বর্জন করে বসে থাকবেন? তাহলে আর রাজনীতি করার মতো কিছু কি হাতে থাকবে দলটির? আগামীর নেতৃত্বে কারা আসবেন? কোন প্রক্রিয়ায় আসবেন? এখনকার নেতাদের কেউ কি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছেন? বিএনপি চেয়ারপারসন দুর্নীতির দায়ে এখন জেলে আছেন। সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা তারেক রহমান পলাতক আছেন। লন্ডনে বসেই তিনি এখনও দল চালানোর চেষ্টা করছেন।
পত্রিকার সংবাদ এসেছে ছাত্রদলের আগামী দিনের নেতা হওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টাদের জীবনবৃত্তান্ত চেয়ে পাঠিয়েছেন তিনি লন্ডনে। এর আগে জাতীয় নির্বাচনেও একই কায়দায় প্রার্থী কেনাবেচা প্রক্রিয়া প্রায় ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল। কী আশ্চর্যের সংবাদ। যে ব্যক্তি নিজে দেশে নেই, অনেক বছর ধরে যিনি দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পালসকেই ধরতে ব্যর্থ, সেই ব্যক্তি কিনা নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছেন বিএনপির মতো একটি বড় দলকে? সত্যি অবাক হওয়ার মতোই সংবাদ। একজন পলাতক আসামিকে এখনও কিসের এত ভয় বিএনপির অন্য নেতাদের? কেন অন্য নেতারা কেউ কথা বলছেন না এটাও একটা বড় প্রশ্ন বটে। যে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আইএস সংশ্লিষ্টতা কেবল দেশেই নয় বিদেশেও অভিযোগ রয়েছে, তার হাতেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। অথচ এই একজন মানুষের সাথে দলের তৃণমূলের কোনও কর্মী বা নেতার নেই কোনও সংযোগ বা মতবিনিময়। না তিনি জানেন মাঠের কর্মীরা কী চায়, না কর্মীরা জানে নেতা কী চায়। এ এক অদ্ভুত রাজনৈতিক দলের কর্মপ্রক্রিয়া, যেখানে ভার্চুয়ালি সব চলে। মাঠের রাজনীতিকে অস্বীকার করে কে কবে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পেরেছেন? কেউ পারেনি আর ভবিষ্যতেও কেউ পারবে না।
তাই এখনও সময় হারিয়ে যায়নি। বিএনপির উচিত এখনই দলকে নিয়ে চুলচের বিশ্লেষণে যাওয়া। কোথায় কোন ধরনের পরিবর্তন আনলে আবারও বাংলার মাটিতে দাঁড়াতে পারবে সে বিষয়টিকে অনুধাবন করতে চাওয়াই হবে তাদের রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা।
লেখক: কলামিস্ট