বিএনপিকে সুসংগঠিত তথা উপযুক্ত শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে হলে কী করা প্রয়োজন কিংবা দলটি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না সে বিষয়ে গণমাধ্যম মোটামুটি সরব। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ‘গণমাধ্যমে বিএনপির প্রচারই বেশি’- একেবারে অমূলকও নয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিদগ্ধজনের মতামত-বিশ্লেষণ এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত টক-শো থেকে বিএনপির পুনরুজ্জীবনের দাওয়াই অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। এসব দাওয়াই থেকে একটি জিনিস মনে হতেই পারে, দলটির পুনরুজ্জীবনের জন্য কিছু লোকের এক ধরনের মায়াকান্না আছে; হয়তো তার গভীরে ভালোবাসাও আছে। এই মায়াকান্নায় যারা মুখর তাদের মধ্যে দলটির নেতৃস্থানীয় থেকে শুরু করে একেবারে মাঠপর্যায়ের সাধারণ শুভাকাঙ্ক্ষীরাও আছেন। এসব শুভাকাঙ্ক্ষীর মধ্যে আবার প্রচ্ছন্নভাবে সক্রিয় আছেন সুশীল সমাজরূপে খ্যাত গোষ্ঠীরও কেউ কেউ। তা সত্ত্বেও আপাতদৃষ্টে দলটির পুনরুজ্জীবনের সুস্পষ্ট কোনও লক্ষণ কারও দাওয়াই থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। আকাশকুসুম একটি কল্পচারী রূপরেখার অস্পষ্ট আভাস অনেকেই দলটির উদ্দেশ্যে বাতলে দিচ্ছেন বটে, কিন্তু তাতে বিএনপির আশুরোগমুক্তি ঘটছে না; নিকট ভবিষ্যতে যে ঘটবে সে সম্ভাবনাও অনেক ক্ষীণ। আরও একটি গভীর প্রশ্ন আমাদের মনে মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি মারে বৈকি। তা হলো দাওয়াই ও পথ্য দেওয়া ডাক্তার-বদ্যিদের কল্পনামতো যদিও রোগমুক্তি ঘটে তাহলে পুনরুজ্জীবিত বিএনপির চেহারা-অবয়ব কীরূপ হবে? দলটির ভবিষ্যৎ পুনরুজ্জীবিত চেহারা কল্পনা করেও আমাদের মনে সে ছবিতে ভাসাতে পারি না। তবে, বর্ণিত মায়াকান্নার সঙ্গে জড়িতরা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ সেই বিএনপির পরিচ্ছন্ন ও সৌম্যকান্ত অবয়ব প্রত্যক্ষ করতে পারেন! পারলে ভালো।
কীভাবে বিএনপি তার পূর্বের অবয়ব ও শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশে সক্ষম হবে? পরিবারতন্ত্র নিয়ে অনেকের মধ্যে ‘নাক ছিটকানো’ ভাব বিরাজ করলেও উপমহাদেশীয় রাজনীতি তা থেকে কখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। উপমহাদেশীয় সমাজ-অগ্রগতির ইতিহাসলগ্নতার কারণে অনেকের মধ্যেই রাজনীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের নির্দিষ্ট কয়েকটি পরিবারকে সেসব দেশের জনগণ উপেক্ষা করতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষও পারেনি। অন্তত দুটি পরিবারকে ঐতিহাসিক কারণেই রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যেমন সহজ নয় তেমনি বর্ণিত দুটি পরিবারকে দেশের কল্যাণ ও অগ্রগতির জন্য গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার দুটির একটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এবং অন্যটি জিয়াউর রহমানের। বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধুর পরিবার বা পরিবারের উত্তরসূরিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করার প্রত্যয়ী লোকেদের নিয়ে সংগঠিত। ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তাদের আদর্শিক অবস্থান।
অপরদিকে জিয়াউর রহমানের পরিবারের উত্তরসূরিরা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বিরোধী ভূমিকা গ্রহণই শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে সঙ্গে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশভাগ অর্থাৎ মন্ত্রিত্ব প্রদান করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের মনে তীব্র আঘাত দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ধর্মীয় বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতিতে জয়লাভের অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছে। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে সামরিক প্রক্রিয়া ও পন্থায় জিয়া পরিবারের উত্থান ঘটে। আর তাকে সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে প্রথমত আত্মরক্ষা, দ্বিতীয়ত ক্রমশ এদেশের রাজনীতিতে পুনর্বহালের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীরা। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে সাম্প্রদায়িক এইসব শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসে প্রকৃত ইতিহাসের গতিধারা মিথ্যা ও চাতুর্যপূর্ণ কৌশলের আবরণে ঢেকে ফেলা হয়। আর এজন্য দেখা যায় সেনা ছাউনিতে জন্ম নেওয়া জিয়াউর রহমানের দলটি দ্রুত ভারী হয়। জিয়ার মৃত্যুর পর তার পারিবারিক সদস্যদের উত্থানের পথ সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকে।
শত-সহস্র দাওয়াই কিংবা লক্ষ লক্ষ পরামর্শ দিলেও বিএনপির পুনরুজ্জীবন ঘটবে না। তবে, যদি জিয়া পরিবারের নিবেদিতপ্রাণ কোনও সদস্য দলটির হাল ধরেন সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা হয়তো আছে। অর্থাৎ বিএনপিকে টিকিয়ে রাখতে হলে জিয়া পরিবারের সদস্যকেই দলটির হাল ধরতে হবে। সেক্ষেত্রে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের আপাত বিকল্প কে আছেন পরামর্শদাতাদের তার নামটি বলে তাকে দলের হাল ধরার অনুরোধ জানাতে হবে। অথবা, নিজ থেকে উদ্যোগী হয়েই জিয়া পরিবারের কোনও সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বিবেচনায় পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক ঐতিহ্যের ধারায় এটিই হতে পারে বিএনপির জন্য শ্রেষ্ঠ দাওয়াই- যাকে আমি বলতে চাই ‘শেষ চিকিৎসা’। এ কথা ঠিক, খালেদা জিয়াকে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্ত করা সহজ নয়। তাছাড়া বর্তমানে নানাভাবে বিপর্যস্ত বিএনপি পক্ষে তা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বিএনপিকে আইনের মাধ্যমেই অগ্রসর হতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ায়ও খালেদা জিয়ার মুক্তি এক সুদূর ভবিষ্যতের কল্পনামাত্র।
সরকারের পক্ষ থেকে মাঝেমধ্যে দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক জিয়াকে লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনার যেসব হুমকিধামকি দেওয়া হচ্ছে তার সারবত্তা গভীর না হলেও সরকার খালেদা জিয়াকে কারাগারে প্রেরণের সময় বিএনপির শক্তিমত্তা ভালোই উপলব্ধি করেছে। দলের চেয়ারপারসন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে কারাগারে যাওয়ার ঘটনায়ও দলটি তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। সেই উপলব্ধি থেকে সরকারের মানসিক সাহসও সঞ্চিত হয়েছে অনেক। কারণ ইতোমধ্যে সরকারের শক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটেনের সঙ্গে ‘আলোচনা’ ফলপ্রসূ হলে এবং তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে কারাগারে নিক্ষেপ করলেও বিপর্যস্ত বিএনপির কেবল ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে (জেলে) গেলে’- মনে মনে এ গানের বিকল্প কোনও কিছু থাকবে বলে আমার মনে হয় না। সরকারের ভেতর সম্ভবত সেরকম আত্মবিশ্বাসই গভীরভাবে প্রোথিত।
তবু আমরা এখনো সন্ধিহান, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনা বিষয়ে সরকারের ঘোষণা আসলে ‘জুজুর ভয়’ না অন্য কিছু!
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।