X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিশোর আন্দোলনের জয়-পরাজয় ও শত্রু-মিত্র

আহমেদ আমিনুল ইসলাম
১৪ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৩৫আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০১৮, ২০:৫৪

আহমেদ আমিনুল ইসলাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর থেকেই বাঙালির জীবনে আগস্ট শোকের মাস। এবারের শোকের আগস্ট শুরু হয়েছিল ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর (হত্যাকাণ্ড বলাই শ্রেয়) ঘটনায় সৃষ্ট উত্তেজনা ও বিক্ষোভ নিয়ে। সমগ্র দেশের কোমলমতি কিশোরদের এই উত্তেজনা ও বিক্ষোভের গভীরে লুকায়িত ছিল নানা রকমের অনিয়ম-অবিচার-স্বেচ্ছাচারিতার অন্তহীনতা। সবকিছু ছাপিয়ে সহপাঠীর মৃত্যুকে ঘিরে নৌমন্ত্রীর ‘হাসি’ সমগ্র দেশের শিশু-কিশোরদের আরও বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। জাতি সেই অবাঞ্ছিত হাসির জন্য লজ্জা পেয়েছে। অথচ মন্ত্রী মহোদয় লজ্জিত হননি, ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন কৌশলী ভঙ্গিতে; তাও আবার বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে! মুজিব কোটের মর্যাদা আবার ভূলুণ্ঠিত হতে দেখলাম। ভুলের জন্য ‘দুঃখিত’ হওয়া বা ‘সরি’ বলার সংস্কৃতি কবে জাগ্রত হবে জানি না। এখনও নানা মহলে চলছে কিশোরদের সংগঠিত আন্দোলন, আন্দোলনে অনুপ্রবেশিত রাজনীতি, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের ভয়াবহ খেলা এবং ইনোসেন্ট একটি আন্দোলনকে ভিন্নমাত্রা দানের লক্ষ্যে দেশ-বিদেশ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত বহুমাত্রিক গুজবের পোস্টমর্টেম। চলছে আন্দোলনকারী, সরকার, বিএনপি-জামাত, তৃতীয় ও চতুর্থ পক্ষ নিয়ে চুলচেরা নানাবিধ অনুসন্ধান- বিশ্লেষণ। নানা রকমের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েও ঘটে যাওয়া আন্দোলন থেকে যেমন কিছু প্রশ্নচিহ্ন আমাদের সামনে আসে তেমনি আবার সেসব প্রশ্নের কিছু গোজামিল উত্তরও হামেশাই দেখতে পাই। বলার অপেক্ষা রাখে না, সেসব উত্তর আমাদের মানবিক বহুবিধ জিজ্ঞাসাকে দুর্বল করে দেয়।

আমরা শিশুদের নিকট থেকে আন্দোলন শুরুর প্রথম দুই-তিন দিন কিছু আইনি শৃঙ্খলা শিখেছি। শোনা যায় আইন সকলের জন্য সমান। সকল নাগরিকের সমান অধিকারের বিষয়টিও নানাক্ষেত্রে আলোচিত, উচ্চারিত। কিন্তু কার্যত এ দুটি বিষয়ের মধ্যেই আছে রাজ্যের যত ঝামেলা, অন্তহীন ‘আইনি মারপ্যাঁচ’। অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় ‘জোর যার মুলুক তার’। এসবের সত্যতা জানতে হলে আইনি বড় বড় কিতাব খুলে দেখতে হবে নিশ্চয়ই। আইন সকলের জন্য সমান হলে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনে শিশু-কিশোরদের অভিনব পদ্ধতিতে ধৃত বিভিন্ন এমপি ও মন্ত্রী মহোদয়দের গাড়ির চালকের কাছে বৈধ লাইসেন্স পাওয়া যেত। কারণ সেসব গাড়ির মালিকেরাই তো দেশের আইন প্রণেতা। কিন্তু ভাবখানা এমন, চালকগণ যেহেতু আইন প্রণেতাদেরই গাড়ি চালান সুতরাং তাদের আইন মানার প্রয়োজন কী? আইনকে যত প্রকারে অশ্রদ্ধা ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো সম্ভব তত প্রকারেই তারা তাই করেন। একে তো মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ির আকার-আয়তন, রং-ঢং, চাকচিক্য তদুপরি সঙ্গে থাকা আইনি ‘প্রটোকল’ অনুযায়ী পুলিশি বহর- এসব ভেদ করে চালকের লাইসেন্স দেখবার দুঃসাহসইবা রাস্তার ট্রাফিক পুলিশ পাবে কোথায়? যদিওবা সাহস পান তবে ‘চাট্টিবাট্টি গোল’ করে অর্থাৎ পাততাড়ি গুটিয়ে চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে; আর ভাগ্য যদি বেশি ভালো থাকে তবে বান্দরবান বা খাগড়াছড়ি তার কপালে জুটে যাবে মুহূর্তেই, স্পট ট্রান্সফার! অতএব, ছাপোষা ট্রাফিক পুলিশের সাহস দেখানোর সংস্কৃতি না থাকাই ভালো। তার আইন সুরক্ষা ও ব্যক্তিত্বের জন্য না হলেও অন্তত তার পরিবারের সদস্যদের জন্য অবশ্যই ভালো চাকরিটা থাকে!
গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে ‘কুপির নিচে অন্ধকার’। আমাদের দেশের মন্ত্রী ও এমপি মহোদয়রাও সেই কুপি বাতির মতো। নিজেরা আইন তৈরি করেন ঠিকই কিন্তু নিজেরা তা মেনে চলার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করেন না। আমাদের রাষ্ট্রের পুলিশেরও সেই একই দশা। নিজেরা অহরহ আইন লঙ্ঘন করে সাধারণের আইন মেনে চলার বিষয় তদারকি করেন। ট্রাক-ভ্যান-বাইক চালানো অনেক পুলিশের কাছে যখন ছাত্ররা লাইসেন্স দেখতে চাইলো তখন তারা উত্তর দিলেন পুলিশের লাইসেন্স লাগে না। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’- আমাদের দেশের মধ্যযুগের কবি-দার্শনিকেরা এরূপ হিতোপদেশ দিয়ে গেলেও আজও আমরা তা রপ্ত করতে পারিনি, রপ্ত করার লক্ষ্যে কালেভদ্রে তা অনুশীলনও করি না। একপ্রকার জোর করেই চলি। যেসব পুলিশ কর্মকর্তারা ‘পুলিশের লাইসেন্স লাগে না’ বলে বেআইনিভাবে সড়ক, মহাসড়ক বা রাজপথে নায়কোচিত আচরণে সাধারণ মানুষকে তটস্থ করেন তাদের উক্ত বক্তব্য সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট বক্তব্য জনগণ প্রত্যাশা করে। কারণ, নিরীহ মানুষ সত্যি মনে করে, পুলিশরা বাস্তবিকই আইনের ঊর্ধ্বে! রাজপথ কিংবা সড়ক-মহাসড়কে সত্যিই কি আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কিংবা এমপি মন্ত্রীদের লাইসেন্স লাগবে না? সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের উচিত বিষয়টি দ্রুত জনগণকে পরিষ্কার করা। জানি এটাও সম্ভব হবে না। কারণ, আমাদের গায়ে-গতরের চামড়া এতটাই স্ফীত ও বোধহীন হয়ে গেছে যে সাধারণের আর্তনাদ, সাধারণের স্বাভাবিক চাহিদা সেই চামড়া ভেদ করে মর্মে পৌঁছাতে পারে না। তাই আন্তরিক অনুভূতি ও মানবিক বোধ নিয়ে সেসব বিবেচনা করাও ভাবলেশহীন, বোধহীন ও স্ফীতোদর কর্তৃপক্ষ কখনো করতে চান না; করেন না। অথচ একটি দেশের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দূরাগত স্বপ্নকেই বাস্তবে পরিণত করে শিশুরা সাফল্যের সঙ্গে দেখিয়ে ছাড়ল! তাই শিশু-কিশোরদের অন্তত এটুকু বলে কৃতিত্ব দিতে হবে যে তাদের আন্দোলনের একটি উদ্দেশ্য অবশ্যই সফল হয়েছে, জয়ও হয়েছে তাদেরই। আবার তাদের এও মনে রাখতে হবে যে কোনও আন্দোলনই সার্বিকভাবে একবারে সাফল্য লাভ করে না। সময় লাগবে।
শিশুদের আন্দোলন দেখে বরং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ব্যর্থতা বেশি চোখে পড়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে সরকার দলীয় যেসব জনপ্রতিনিধি বা সাংসদগণ ছিলেন, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান ছাড়া আর কেউ শিক্ষার্থীদের কাছে আসলেন না, তাদের কাছ ঘেঁষলেন না পর্যন্ত! কেন এমনটি হলো তা কি তারা বলবেন? তারা নিজেরাই নিজেদের এভাবে এতটা জনবিচ্ছিন্ন কী করে করলেন তাও আমাদের বিস্মিত করে! তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। সেই ভিডিওটি ভালো সন্দেহ নেই কিন্তু তিনি নিজে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালেই বেশি ভালো করতেন। সাধারণ মানুষ কিংবা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভেবে নেওয়ার অবকাশ তৈরি হয়েছিল যে সরকার তাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নিচ্ছে না। আন্দোলন বিক্ষোভ যেকোনও সময়ই হতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দলের কাছে দেশবাসী এটি আশা করেনি। এই আন্দোলন থেকে আওয়ামী লীগকেই বেশি অর্জন করা উচিত ছিল বলে সাধারণের বিশ্বাস। কারণ, এদেশে শিশু-কিশোর মিলিয়ে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চার কোটি। এসব শিশু কিশোরের মনোজগতে আওয়ামী লীগের একটি ইতিবাচক ইমেজ প্রতিষ্ঠা জরুরি ছিল। কিন্তু এ সুযোগটি বিভ্রান্তি ও গুজব রটনাকারীদের কাছে ছেড়ে দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারবিরোধী প্রচারণা দ্বারাই তারা বেশি আকৃষ্ট হয়েছে। ফলে যত গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্যই হোক, সেসব বক্তব্য শিশুমনে যখন একবার রেখাপাত করেছে তখন সেখান থেকে নানা প্রশ্নে নানাভাবে তারা প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কেও দ্বিধাগ্রস্ত হবে। প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগকে মনে রাখতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়নের কারণে তার শত্রু ও ষড়যন্ত্রকারীর সংখ্যা পূর্বের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং যেকোনও ঘটনা-দুর্ঘটনাকে উপজীব্য করে তারা কেন বসে থাকবে?
শেষ পর্যন্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছে, স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষে নিয়মিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, স্কুল বা ঘরে ফেরা শিক্ষার্থীরা কী মনের ভেতর কোনও খেদ পোষণ ছড়াই ঘরে ফিরেছে? যদি তাদের মনে কোনও ধরনের খেদ থাকে তাবে ভবিষ্যতে যেকোনও ঘটনায় পুনরায় রাস্তায় নেমে আসতে পারে। এই মুহূর্তে স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে এক ধরনের কাউন্সিলিং হওয়া প্রয়োজন। তাদের এটা বুঝানো প্রয়োজন, তাদের প্রকৃত আন্দোলনটুকু অবশ্যই সার্থক হয়েছে। অপরদিকে তাদের আন্দোলন নিয়ে যারা ঘোলাপানিতে মাছ শিকারে প্রবৃত্ত হয়েছিল তারাই নানাভাবে ব্যর্থ ও পর্যুদস্ত হয়েছে। তাদের মনের খেদ আস্তে আস্তে কমিয়ে আনতে হবে।
পুনশ্চ. সড়কে শিক্ষার্থীরা যে সাময়িক শৃঙ্খলা প্রবর্তন করেছিল হয়তো ভবিষ্যতে কোনও একদিন তা দৈনন্দিনের বাস্তবতায় পরিণত হবে। কিন্তু আন্দোলন পরবর্তী সময়ের পত্রপত্রিকার খবর থেকে যা জানা যাচ্ছে সেদিকে তাকালে বুঝা যায়, নাগরিকদের মধ্যেই আসলে নাগরিকবোধ সৃষ্টি হয়নি। মনে কষ্ট পেলেও বাস্তবতা এই যে, অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনের পরে সড়কের শৃঙ্খলা মান্য করে চলাচল করছে না। একাধিক টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় সেই চিত্র আমরা আন্দোলনের পর বেশ কদিন ধরেই দেখেছি। সুতরাং আমাদের নাগরিকবোধ, নাগরিক চেতনা আগে তৈরি করতে হবে। আমরা অনেকেই অনেক সময় ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাসের দাবি তুলি কিন্তু তা ব্যবহারে অভ্যস্ত হতে চাই না। এখনো সেই পূর্বের দৃশ্যই বহাল আছে। নাগরিক বিষয়গুলো সবাইকে সচেতনতার সঙ্গে মেনে চলার বিকল্প নেই। আন্দোলনের প্রথম কয়েক দিন আমাদের শিশু-কিশোররা অনেক কিছু সম্ভব করে দেখিয়েছে, আমরাও করেছি। আন্দোলনের পরে কেন শিশু-কিশোররা সেই একই জিনিস পারবে না? আমরাইবা কেন ন্যায়বোধ ও নাগরিক চেতনাবোধে জাগ্রত হবো না? সকল বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটুক শিশুদের নির্মল আন্দোলনের প্রেরণায়। আর সেই আন্দোলনের ভেতর দুরভিসন্ধিমূলক অনুপ্রবেশের মাধ্যমে যারা ভিন্ন কিছু অর্জন করতে চেয়েছিল তাদের চেহারা দ্রুত স্পষ্ট করা হোক সকল শিশুর সামনে। শিশুরাও চিনে নিক তার আপন-পর, চিনে নিক তার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের শত্রু -মিত্র।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ