প্রশ্ন হলো, জাহাঙ্গীর আহমেদ কেন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেন? তিনি কি জানতেন তার পরাজয় নিশ্চিত? এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, যেহেতু ইকরামুল হক টিটু প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত প্রার্থী, তাই তিনি দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে টিটুকে সমর্থন জানিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে গেছেন। কিন্তু একটি সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র বিনা ভোটে জয়ী হলেন, এটি তার নিজের জন্যইবা কতটুকু সম্মানের? টিটু বলছেন, নির্বাচনের মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। ফলে চাইলে যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন। কিন্তু পরজিত হওয়ার আশঙ্কায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী সরে গেছেন বলে তিনি মনে করেন।
প্রশ্ন হলো, রাজধানীর সন্নিকটে এই সিটি করপোরেশনের ভোটারদের যে তাদের প্রথম মেয়র নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো, তার দায় কে নেবে? আইনত ইকরামুল হক নির্বাচিত মেয়র। কিন্তু জনগণ তো তাকে ভোট দেয়নি বা ভোটের প্রয়োজনই পড়েনি। সেক্ষেত্রে তাকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বলার সুযোগ আছে কিনা? অন্তত নৈতিক বিবেচনায় তাকে নির্বাচিত প্রতিনিধি বলা চলে না। আবার তিনি যেহেতু জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি, ফলে জনগণের তথা নাগরিকের প্রতি তার কমিটমেন্ট, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি কতটুকু থাকবে সেটিও প্রশ্নসাপেক্ষ।
বাস্তবতা হলো, তিনি অনেক বেশি দায়বদ্ধ থাকবেন যে দল তাকে মনোনয়ন দিয়েছে, সেই দলের প্রতি। প্রথমত সেই দলের প্রতি সব সময়ই তাকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে, তাকে আনুগত্যের পরীক্ষা দিতে হবে এবং ভবিষ্যতেও যাতে তিনি মনোনয়ন পান তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট থাকতে হবে। ফলে দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে ওঠে তিনি নাগরিকের সেবা দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার যেহেতু তিনি সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন, ফলে তার কাছে ভোটার ও নাগরিকরা কতটুকু মূল্যায়িত হবেন, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। তবে এই কথাগুলো শুধু ময়মনসিংহ সিটি মেয়রের জন্যই নয়, জাতীয় ও স্থানীয় সরকারে যারাই এরকম বিনা ভোটে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন, হচ্ছেন এবং হবেন—তাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য। কারণ, যিনি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর স্বচ্ছ ভোটের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তার নৈতিক বল যেমন অনেক বেশি থাকে, তেমনি তার কাছে নাগরিকদের প্রত্যাশাও থাকে অনেক। কিন্তু যার নির্বাচিত হওয়ার পেছনে ভোট প্রয়োজন হয়নি, তিনি বস্তুত সিলেকটেড বা মনোনীত। একজন নির্বাচিত এবং একজন মনোনীত জনপ্রতিনিধির সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা কখনোই সমান নয়।
রাজধানীর কাছে এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিটিতে ভোট ছাড়াই মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় বলা চলে ভোট উৎসব পুরোপুরি ম্লান হয়ে গেছে। কাউন্সিলর পদে ভোট হলেও ভোটারদের মূল আগ্রহ থাকে মেয়রকে নিয়েই। ফলে এই সিটির নাগরিকরা যে নিজেদের পছন্দমতো মেয়র নির্বাচিত করতে পারলেন না, তার জবাবদিহি কোথায়? অবশ্য পাল্টা প্রশ্নও করা যায় যে, যেখানে খোদ আইনপ্রণেতা অর্থাৎ জাতীয় সংসদের সদস্যরাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান, সেখানে সিটি মেয়রের কী দোষ! শঙ্কার বিষয় হলো, এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে একসময় পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতিই মানুষের আগ্রহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। নির্বাচন নিয়ে নানা কারণেই ভোটারদের অনীহা বা অনাগ্রহ সাম্প্রতিক একাধিক নির্বাচনে স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত যে নির্বাচন, তার প্রতি নাগরিকের অনাগ্রহ বা অনীহা যে আখেরে গণতন্ত্রকেই দুর্বল ও প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং এর ফলে ভবিষ্যতে আমরা কী ধরনের রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাবো—তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশের অবকাশ রয়েছে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা প্রতিনিধি নির্বাচনে ভোটই প্রধান উপায়। আর ভোট বলতে বোঝায় গোপন ব্যালটে স্বাধীন ও নির্ভয়ে নাগরিকের অধিকার প্রয়োগ। অর্থাৎ একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ হচ্ছে নির্বাচন। এটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সুতরাং যখন কেউ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তখন সেখানে নাগরিকের এই সাংবিধানিক অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়। সেটি স্থানীয় সরকার হোক কিংবা জাতীয় সংসদ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেড়শোর বেশি প্রার্থী এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিরল।
আমাদের নির্বাচন কমিশন কখনোই এটি বলে না যে, যেহেতু একাধিক প্রার্থী নেই, তাই পুনরায় তফসিল হবে এবং নতুন করে নির্বাচন হবে। কারণ আইনত ও সাংবিধানিকভাবে আমাদের নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও তারা সরকার ও সরকারি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে কতটুকু কী করতে পারেন, তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে বলে আমি মনে করি। বর্তমান কমিশনের একজন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনে অনেকের এভাবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সমালোচনা করে প্রশ্ন তুলেছেন, নির্বাচন মানেই হচ্ছে একাধিকের মধ্যে বাছাই। তাই যা প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, তা নির্বাচন হয় কী করে? স্থানীয় সরকারের নির্বাচন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনার সংস্কার প্রয়োজন বলেও মনে করেন এই কমিশনার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অন্য চারজন কমিশনারের সঙ্গে তার কথা মেলে না। এর আগে আরও অনেক ইস্যুতে তিনি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মন্তব্য করেছেন। এই কথাগুলো পুরো কমিশন একস্বরে বললে দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা যেভাবে ক্রমশই ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে, সেই পরিস্থিতি এড়োনো যেতো। এখন যেভাবে সকল স্তরে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ শূন্যে নেমে যাবে এবং তখন আর ভোট আয়োজনেরই প্রয়োজন হবে না। বরং কেন্দ্রে থেকে নাম মনোনীত করে পাঠানো হবে এবং নির্বাচন কমিশন তাদের নির্বাচিত বলে ঘোষণা করবে।
তবে শুধু জাতীয় সংসদ বা স্থানীয় সরকারই নয়, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের ২০১৯-২০২১ মেয়াদের দ্বিবার্ষিক নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবাই বিজয়ী হয়েছেন। ৪ এপ্রিল বিকেলে নির্বাচন কমিশন এফবিসিসিআইয়ের বৈধ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। কোনও পদেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় এসব পদে আর নির্বাচন হচ্ছে না। ২৭ এপ্রিল এফবিসিসিআইয়ের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচনে ভোট হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ বিনা ভোটে বা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই ঘটনা এখন দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক চর্চার পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এর মূল কারণ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিপক্ষে কোনও শক্তিশালী দল বা প্রার্থী না থাকা। রাজনীতি ও ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এখন বহুবিধ সংকটে নিমজ্জিত। দলের ভেতরে নেতৃত্বহীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা, কোন্দল, মামলায় ভারাক্রান্ত নেতাদের হাল ছেড়ে দেওয়া, বছরের পর বছর ক্ষমতার বাইরে থাকায় কর্মীদের নিস্তেজ হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে বিএনপি এখন খাদের কিনারে। ফলে আওয়ামী লীগের সামনে এখন ওই অর্থে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এমনকি জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাচ্ছেন না। কারণ তারা ভোটের ফলাফল জানেন। দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থার এই বেহাল দশার জন্য বিএনপিও কি তার দায় এড়াতে পারে? সেটি অন্য তর্ক। তবে এ মুহূর্তের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে যাত্রা শুরুর পর দেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় যে সংস্কার ও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিলো, সেই ধারাবাহিকতায় হঠাৎ করে কেন ছন্দপতন হলো? এখানে কোন দলের ভূমিকা কতটুকু—তার একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ যেভাবে কমছে তাতে আগামী ১০ বছর পরে ভোটকেন্দ্রের চিত্র কী দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল। নাকি এখানে আমূল পরিবর্তন আসবে? তার কি কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচন অর্থবহ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনেক। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সরকার ও ক্ষমতাসীন দল দেশে কেমন নির্বাচনি ব্যবস্থা চায়, তার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন কমিশন কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে তা হলো, কেউ কি চাচ্ছে দেশের নির্বাচিন ব্যবস্থাটি বিতর্কিত হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছে যাক, যাতে মানুষ আর ভোটের নামই মুখে না আনে?
লেখক: সাংবাদিক।