একথা মানতেই হবে সংবাদপত্রের চেয়ে দেশে এখন টেলিভিশন মাধ্যমের প্রভাব বেশি। কারণ সেকেন্ডে সেকেন্ডে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো নতুন নতুন খবর দিচ্ছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ‘স্ক্রল’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। কারণ নতুন খবর ভেসে ওঠে স্ক্রলের মাধ্যমেই। সে কারণে দেশে কোনও দুর্যোগ হলেই প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে সতর্ক চোখ যায় সবার। ফণীর খবরের আপডেট পাওয়ার জন্য গত কয়েকদিনে প্রায় প্রতিটি টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রল বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল দুর্যোগপূর্ণ এলাকা থেকে প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন।
প্রসঙ্গক্রমে বিনীতভাবে একটা কথা বলতে চাই। দুর্যোগে পড়লেই বোঝা যায় আমরা কে কোথায় কতটা সামর্থ্য অর্জন করেছি। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় দেশের নানা প্রান্তে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীরা প্রতিনিধি হিসেবে যুক্ত হয়েছেন। এদের সকলে কি পেয়েছেন ন্যূনতম কোনও প্রশিক্ষণ? দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিনিধিরা ‘ফণীর’ আপডেট দিচ্ছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিলো ঘূর্ণিঝড়ের খবরের আপডেট কীভাবে দিতে হবে সে ব্যাপারে অনেকেই তেমন প্রস্তুত নন। একটি টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়েই বৃষ্টিভেজা শরীর নিয়ে ফণীর আপডেট দিচ্ছিলেন। তিনি কথা বলার সময় বারবারই ‘কিন্তু’ শব্দটি ব্যবহার করছিলেন। ফলে তার কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। বারবারই একটা কথা মনে হচ্ছিলো, ওই সাংবাদিক বন্ধু কি প্রশিক্ষিত? তার টিভি চ্যানেল থেকে কি কখনও তার ভুল ধরিয়ে দেওয়া হয়?
ভুলের কথা যখন উঠলো তখন একটা প্রসঙ্গের অবতারণা না করে পারছি না। একটু আগেই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় ‘স্ক্রলে’র গুরুত্বের কথা বলেছি। ঘূর্ণিঝড় হিসেবে ফণীর অবস্থান জানার জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর স্ক্রলের ওপর ভরসা করছিলো সারা দেশের মানুষ। অথচ এক টেলিভিশন চ্যানেল থেকে অন্য টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। ৩ মে গভীর রাতে ফণীর খবর জানার জন্য টেলিভিশন খুলে দেখি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে স্ক্রল যাচ্ছে আগামীকাল সকাল ১১টার দিকে ফণী বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। আরেকটি চ্যানেলে স্ক্রলে ভাসছে ভোরে বাংলাদেশ অতিক্রম করবে ফণী। আবহাওয়ার তথ্য নিশ্চয়ই আমাদের আবহাওয়া অধিদফতর থেকেই সংগ্রহ করা হয়। তাহলে কেন এই তথ্যবিভ্রাট? কেউ বলছেন ভোরের কথা। আবার কেউ বলছেন বেলা ১১টার কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই দেখলাম ফণীর অবস্থানের ব্যাপারে আমাদের আবহাওয়া অধিদফতরের সামর্থ্য নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। সাংবাদিক আনোয়ার আল দ্বীন লিখেছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে গত কয়েকদিনে নিবিড় আলাপচারিতায় উপলব্ধি করেছি তারা তেমন কিছুই জানেন না। আনোয়ার আল দ্বীনের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে সেটা হবে মারাত্মক দুশ্চিন্তার বিষয়।
ঘূর্ণিঝড় ফণীকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে কত কিছুই না ঘটে গেলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাজনের নানান প্রতিক্রিয়া। কারও প্রতিক্রিয়া পড়ে মনে হলো ফণী বাংলাদেশে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত না করায় একটু মনক্ষুণ্ন। ভাবটা এমন, ফণী একজন বিদেশি খেলোয়াড়। বাংলাদেশে খেলতে আসার কথা। এলো ঠিকই। কিন্তু ফুটবল খেলল না। এজন্যই তারা অখুশি। ফেসবুকে একজন লিখেছেন, যা ভেবেছিলাম সেরকম তো কিছুই হলো না। আরেকজন লিখেছেন, ফণী ও ওড়িশায় আঘাত হানার পরও ৬ জন মানুষ মরেছে। আর আমাদের এখানে ফণী আঘাত না করলেও মানুষ মরলো বেশি। এই ব্যর্থতা কার? ফণী ঘূর্ণিঝড়টিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৌতুকপ্রদ ট্রল করার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে। ফণী ঘূর্ণিঝড় রাজনীতির মাঠেও ঢুকে পড়েছে।
ফণী নিয়ে ইতিমধ্যে একটি কেচ্ছাও লিখেছেন দেশের একজন জনপ্রিয় ছড়াকার। তার কেচ্ছাটি এরকম–
ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ নিয়ে একটি উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আসছেন বাংলাদেশ ভ্রমণে।
গরমে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ যদি বলছে ‘আর সহ্য হয় না’, সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলছে, কষ্ট করে আর একটা দিন ধৈর্য ধরেন। ফণী আসছে।
ইয়াং জেনারেশনও উত্তেজিত। ফণীর সঙ্গে একটা সেলফি তুলে ফেসবুকে দেওয়া গেলে এক ধাক্কায়ই কাজ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর উল্টাপাল্টা তথ্য দেওয়ার জন্য বিখ্যাত। তারা যদি বলে, আজ আকাশ থাকবে কর্দমাক্ত কিন্তু মাঠে অল্প মেঘ দেখা যেতে পারে; এর কিছুক্ষণ পরই ঠাডা পড়া শুরু হবে। তারা ফণীবিষয়ক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এই কেচ্ছার বাইরেও আরেকটি কেচ্ছার কথা বলি। ঘূর্ণিঝড় ফণীকে কেন্দ্র করে দেশের প্রচারমাধ্যমগুলো গত কয়েকদিনে বেশ সোচ্চার ছিল। কিন্তু একই ঘটনাকে আমরা একেকজন একেকভাবে বিশ্লেষণ করি। দেখুন তার নমুনা। ৪ মে শুক্রবার ফণীর খবর ছাপতে গিয়ে বহুল প্রচারিত দেশের একটি জাতীয় দৈনিক শিরোনাম করেছে– ‘ফণী এলো ফণা তুলে’। একই দিনে প্রকাশিত অপর একটি জাতীয় দৈনিক শিরোনাম ছেপেছে ‘ফণা তুলে আসেনি ফণী’। একই ঘটনার বিপরীতমুখী বিশ্লেষণ সত্যি অবাক করার মতো।
লেখাটি শেষ করি। তার আগে একটি কথা বলতে চাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আমরা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করছি তাদেরকে ‘বাঘ এলো বাঘ এলো’ সেই গল্পটি মনে করিয়ে দিচ্ছি। রাখাল বালক বাঘ আসার গল্প বলে মানুষকে বারবার বিভ্রান্ত করেছে। শেষে যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ এসেছে সেদিন মরণপণ চিৎকার করেও কাউকে সে কাছে পায়নি। বাঘের কামড়ে মৃত্যু হয়েছে তার। ফণী এবার ফণা তুলতে পারেনি বলে যদি কেউ খুশি হয়ে থাকেন তাহলে তার বা তাদের উদ্দেশে বলি, প্রকৃতি হলো আমাদের মা। সন্তান ভুল করলে মা যেমন নানাভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেন প্রকৃতিও তেমনি নানাভাবে সতর্কবার্তা দেয়। ভেবে নিন ফণী সতর্কবার্তা দিতেই এসেছিল। আসুন প্রকৃতি রক্ষায় সচেতন হই। ক্ষমতার সঙ্গে মমতা যুক্ত করলেই তা সম্ভব।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো