এই কথা নতুন নয়, গত প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে আমরা জেনে আসছি কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে কৃষক ধান বিক্রি করছেন। সেচ, বীজ, সারের সংকটের পাশাপাশি ধানকাটার মজুরের ঘাটতিও আছে। প্রায় দেড় মণ ধানের দামে পাওয়া যাচ্ছে এক বেলার মজুর। কৃষি শ্রমিকরা শহর ও শিল্পমুখী হওয়াতে এই সংকট তৈরি হয়েছে। এক বিঘা জমির গড় ৩০ মন ধান ১৯ হাজার টাকায় ফলিয়ে বিক্রি করছেন ১৭ হাজার বা তারচেয়েও কম দামে।
রাষ্ট্র সেচের জন্য ডিজেল থেকে শুরু করে নানা খাতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে। কিন্তু এখনও প্রকৃত কৃষকের হাতে ভর্তুকির সুবিধা পৌঁছে দেওয়া যায়নি। বর্তমান কৃষিমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন সরকার যে ধান-চাল কিনছে, সেই সুবিধাও মধ্যস্বত্বভোগীদের ডিঙিয়ে কৃষকের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। কৃষকের ধান মজুত রাখার মতো আর্থিক ও অবকাঠামো সচ্ছলতা নেই। ফলে কৃষকদের একটি বড় অংশকে মাঠ থেকেই ধান বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। মজুতদারদের কারসাজিতে দাম যখন বাড়ে, তখন কৃষকের গোলায় ধান নেই।
কৃষকের কপালপোড়ার আরেক কারণ, চাল আমদানি। দেশে আউশ, আমন ধানের বাম্পার ফলন হবে এই পূর্বাভাসের পরেও চাল আমদানি বন্ধ হয়নি। বাম্পার ফলনের বাজারে আরও জল ঢেলে দেওয়া। সরকারের কাছে কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়ার তাৎক্ষণিক সমাধান নেই। সরকার সমাধান খুঁজছে চাল রফতানিতে। সেটি স্থায়ী হিসাব-নিকাশের বিষয়। অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে কোনও তড়িৎ ব্যবস্থাপত্র পাওয়া যাচ্ছে না। তারা জোর দিচ্ছেন সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ আরও আগে শুরু করা যায় কিনা। এবং বীজ বপনের খরচ কমাতে স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা। আর সনাতন কথা-সরকারের কাছে যেহেতু কৃষকের তালিকা আছে, সেহেতু প্রযুক্তি খরচে সরকারের আর্থিক খরচ সহজে পৌঁছানো যায় কিনা এবং কৃষকদের সঙ্গে সরকারকে যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণ।
রাষ্ট্র অবগত থাকার পরেও কৃষককে ভর্তুকি দেওয়া, কৃষি ঋণ, ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারেনি। বরং মধ্যস্বত্বভোগী, মজুত সিন্ডিকেটের কাছে কৃষি ও খাদ্য বিভাগের এক প্রকার অসহায়ত্ব দৃশ্যমান। দুর্নীতি এখন আর শাক দিয়ে ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। হয়নি কখনও। তথ্য প্রকাশের নানা নিয়মনীতির ঢাকনা উড়ে গিয়ে দুর্নীতির খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এখন যেমন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আবাসিক ফ্ল্যাটে মাল উঠানোর দুর্নীতি ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি বালিশ ফ্ল্যাটে তুলে দিয়ে এক মণ ধানের দামের চেয়ে বেশি মজুরি পেয়েছেন এক শ্রমিক। সরকারি ফ্ল্যাটে বিছানার চাদর তুলে দিয়ে সরকারী কর্মচারীরা যে মজুরী নিচ্ছেন, সেটা প্রায় দেড় মন ধানের বিক্রি মূল্যের সমান ।
কৃষক এই দুর্নীতির কথা জানেন। প্রতিবাদ না করে অভিমানে নিজের ফসল পুড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে আমাদের সাবধান থাকা উচিত, অভিমান যখন প্রতিবাদে রূপ নেয়, তা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সাধ্যে কুলোয় না।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি