বার্লিনসহ জার্মানির বিভিন্ন শহর-অঞ্চলে আ.এফ.ডে (এএফডি। অলটারনেটিভ ফ্যুর ডয়েচল্যান্ড। জার্মানির চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। গত নির্বাচনে সংসদেও ঠাঁই নিয়েছে।)-র একটি বিশাল পোস্টার প্রায়-প্রত্যেকের নজর কেড়েছে। পোস্টারে পাশাপাশি দুটি ছবি। একটি ছবিতে জার্মান পিতামাতা এক সন্তান (শিশু নিয়ে হাঁটছে। অন্য ছবিতে, বোরখা পরা এক নারী (অবশ্যই মুসলিম), বয়স ত্রিশও নয়, কোলে-কাঁখে-পিঠে এবং হাত ধরে সামনে-পেছনে আট সন্তান নিয়ে যাচ্ছে। দুই ছবিতেই স্পষ্ট কী বক্তব্য।
গত মাসে লন্ডনে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলুম। এক সন্ধ্যায় আলোচ্য বিষয়: ‘ইউরোপে ইমিগ্রান্টস লিটারেচার’। নানা বক্তার কথায় জানা গেলো, ইউরোপে এখন ইউরোপীয় সাহিত্য সমৃদ্ধ করছে ইমিগ্রান্টস লেখককুল। বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকার।
একজন শ্রোতা, হতে পারেন তিনি বিদ্বেষী, অন্তত তাঁর কথায় স্পষ্ট, আলোচনা চলাকালেই প্রশ্নের বদলে বললেন, ‘এই দেশে বিদেশিদের ভিসা দেওয়া উচিত নয়, ভিসার ব্যাপারে আরো কড়াকড়ি, কঠিনতা প্রয়োজন।’ বলি, ‘তোমরা কি আমাদের দেশে ভিসা নিয়ে গিয়েছিলে? ব্রিটেনের প্রতিটি রাস্তাঘাট, অট্টালিকা আমাদের রক্তে নির্মিত। মাটিতে কান পাতো, শুনবে আমাদের মানুষের কান্না, আর্তনাদ। কেবল ব্রিটেন নয়, ইউরোপের আরও বহু দেশে। রক্ত এখনও শুকোয়নি, বরং ঝরছে, হরেক কৌশলে, উপায়ে।’
- আফ্রিকা, এশিয়া, ক্যারিবিয়েন দীপপুঞ্জের শ্রোতা, সমালোচক, লেখকরা হাততালি দিলে, টেবিল চাপড়ালে। এই নিয়েই শুরু হলো গুঞ্জরন, নানা কথা। ভেসে গেলো সন্ধ্যা-সম্মেলন। খারাপ লাগছিল খুবই, কিন্তু না বলে মৌনী থাকা আরও অপরাধ। পাপের ভাগী হওয়া আরও গুরুতর।
বলছিলুম ইউরোপীয় ইউনিয়নের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে। সাধারণ মানুষ যে অতি উৎসাহী, উদ্দীপ্ত, আদৌ নয়। প্রত্যেকে জানে থোড়বড়িখাঁড়া। যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন। একে রবিবার, উষ্ণ-গ্রীষ্মের আমেজ, আরাম আয়েশই পয়লা। জার্মানির বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ‘ডী টাৎস’ লিখেছে, ‘গোটা ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন)-য়ে, নির্বাচনে, ৪০ ভাগ ভোটও পড়বে না। ইইউ নির্বাচন কার, কোন দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে?’
- প্রায় তিন যুগের বেশি বার্লিনে বাস (তথা ইউরোপে), আগে কখনও দেখিনি, সংবাদপত্রে, টিভি চ্যানেলে জনগণকে ভোট দেওয়ার জন্যে বিজ্ঞাপন, প্রচারণা। জনগণ ভোটবিমুখ, বিজ্ঞাপনেই প্রমাণিত।
ইইউ’র ভোট, নির্বাচনের চেয়ে সাধারণ জার্মানদের অনেক বেশি উৎসাহ ভারতের নির্বাচন নিয়ে। এতটাই উৎসাহ, পরিচিতজন ছাড়াও, অচেনা মানুষ, গা গতরে-চেহারায় ভারতীয় দেখতে বলেই জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনার দেশে নির্বাচন হচ্ছে, এক মাসব্যাপী, তাজ্জব। কোন পার্টি জিতবে, উগ্র হিন্দু পার্টি, নাকি সেক্যুলার পার্টি।’ ধরেই নিচ্ছে বিজেপি উগ্র হিন্দু পার্টি, কংগ্রেস সেক্যুলার পার্টি। ধরে নেওয়ার কারণও আছে। জার্মান মিডিয়ায় এই দুই দলকে নিয়ে খবরাখবর। প্রায় প্রত্যেক দিনই। অভাবনীয়। যা, ইতিপূর্বে কখনও দেখিনি ভারতের নির্বাচনে এতটা মাথাখামচানো।
বিস্ময়কর এই, জার্মানির দুই প্রধান টিভি চ্যানেল ‘এ আর ভি’ এবং ‘জে ডি এফ’ প্রায়-নিত্যদিনই সচিত্র রিপোর্ট করছে। দাঙ্গাহাঙ্গামারও। সচিত্র রিপোর্টে সাধারণ মানুষের সাক্ষাৎকার। বক্তব্য। রিপোর্টে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের দুর্দশা, কাহিল অবস্থা, নানা শ্রেণির সামাজিক অবস্থান, ধর্মবিদ্বেষ (উগ্র-হিন্দু মৌলবাদীর) সবই ক্যামেরা, কথোপকথনে পরিষ্কার।
ভারত ধর্মনিরপেক্ষ, মাল্টি কালচার, মাল্টি রেস (জাতিবর্ণ)-এর দেশ, তাহলে কেন এবারের নির্বাচনে এসব প্রশ্নের কারণ? বলছেন ভোটাররা। বলায়, জার্মানরা ভারতকে আর ভালো চোখে দেখছেন না, প্রমাণ পাচ্ছি হাড়েমজ্জায়। অগ্নিতে আরও ঘি ঢেলেছেন রোমিলা থাপার, নির্বাচনে হিন্দুত্বের অসারতা, মিথ্যা নিয়ে। লিখেছেন দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ, THEY PEDDLE MYTHS AND CALL IT HISTORY শিরোনামে (১৮ মে ২০১৯)। এই লেখা জার্মানির ১১-টি দৈনিকে অনূদিত (প্রকাশিত)। ইইউ’র নির্বাচনের চেয়ে ভারতীয় নির্বাচন কতটা সরগরম জার্মানিতে, টের পাচ্ছি।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক