X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্মদিন, কেন জরুরি মননবোধে

দাউদ হায়দার
১৫ মার্চ ২০২১, ১৪:১৫আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২১, ১৪:১৫

দাউদ হায়দার
‘না পড়ে, না জেনে, না ভেবে, কিছু লিখি না। লিখতে সময় লাগে। ছোট লেখাও সময় নিয়ে লিখি।’ লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়। তাঁর ছোট লেখা, হোক তা রাজনৈতিক বিষয়, স্বল্প পরিসরে, মূল বক্তব্য প্রকাশই আসল লক্ষ্য। ইনিয়ে-বিনিয়ে-ফেনিয়ে লেখা বড়ো করলেই পাঠক আগ্রহী হবে, পড়বে, আদৌ নয়। জানতেন অন্নদাশঙ্কর। তীক্ষ্ণ, সুচারু বুদ্ধিদীপ্ত লেখা সাধারণ পাঠকের কাছেই অধিক মূল্যবান। তবে বিষয়বস্তুর ওপর নির্ভরশীল। তাঁর কিছু রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি সাহিত্য বিষয়ক লেখাও এক-দেড় পৃষ্ঠায়। হলেও ভাবনাচিন্তার খোরাক যথেষ্ট। অন্যদিকে সাহিত্য, রাজনীতি নিয়ে ঢাউস প্রবন্ধও বিস্তর।

ছোটগল্প একেবারে ছোট নয়, উপন্যাসও বিশাল।

বাংলা সাহিত্যে তিনিই প্রথম এপিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘সত্যাসত্য।’ ছয় খণ্ডে সমাপ্ত। প্রতিটি খণ্ডের নাম আলাদা। যৌবনের লেখা। পরিণত বয়সে লিখেছেন ‘ক্রান্তদর্শী।’ চারখণ্ডে। বিষয় ভারত ভাগ, বাংলা ভাগ। রাজনীতির সঙ্গে মিশেল প্রেম সামাজিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, মানবতা, দেশভাগের পূর্বাপর ইতিহাস, ঘটনাবলি বিবৃত। মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ডে উপন্যাসের ইতি।

একটি তথ্য জানানো জরুরি, সব লেখাই তিনি আগে ‘পয়েন্টস নোট’ করেন। অতঃপর নোট সাজিয়ে, যোগবিয়োগ করে লেখা। হতে পারে গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা কিংবা ছড়াও।

আরো একটি তথ্য, লেখা শুরুর আগে লেখার শিরোনাম ঠিক করেন, শিরোনামেই বুঝিয়ে দিতে চান বক্তব্যের সারমর্ম।

অন্নদাশঙ্কর রাজকর্মচারী, অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের কর্মী (ভারত ভাগের আগে)। ছিলেন আইসিএস। উঁচু পদের আমলা। ট্রেনিং বিলেত থেকে। যেহেতু রাজকর্মচারী, লেখালেখিতে কিছু বিধিনিষেধ ছিল। অমান্য করলে ঝামেলা। বেছে নেন ছদ্মনাম: লীলাময় রায়। এই নামে বহু প্রবন্ধ, মূলত সমাজ-রাজনীতি নিয়ে লেখা, ব্রিটেন শাসিত ভারতে প্রকাশিত। লিখেছেন বাংলায়। বাংলার পাঠকের জন্যই। বাংলা তথা বঙ্গদেশই ছিল তাঁর রক্তে, ধমনীতে।

আইসিএস হয়ে বিলেত থেকে ফিরে ভারতের অন্য কোনও রাজ্যেও শাসনকাজে যেতে পারতেন। অনেকেই গিয়েছেন বোম্বে, দিল্লির মায়ায়, কিংবা উচ্চাশায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘ভারতের অন্য রাজ্যের বদলে বাংলা কেন বেছে নিলে?’ সপ্রতিভ উত্তরঃ ‘বাংলাই আমার আরাধ্য।’ রবীন্দ্রনাথ খুশি কি অখুশি চোখেমুখে ভাবান্তর এর চিহ্ন ছিল না।’ ওঁর কাছেই আরো শুনেছিঃ ‘একবার বলতে চেয়েছিলাম আপনি (রবীন্দ্রনাথ) যেখানে আছেন, সেই বাংলা ছেড়ে কেন ভিন রাজ্যে, প্রদেশে যাবো। বলিনি। বললে হয়তো ভাবতেন গুরুদেবকে খুশি করছি।’

আমাদের জানা আছে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময়ই পূর্ব বঙ্গে কাটিয়েছেন। শুরু রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে। (এখানে অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী লীলা রায়ের বাংলা শিক্ষার শিক্ষক ছিলেন ‘হারামণি’ খ্যাত অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন)।

পূর্ববঙ্গের বহু জেলায় আদালতে কখনো বিচারপতি, কখনো জেলাশাসক। বিভাগীয় প্রশাসকও। ভারত ভাগের কয়েক মাস আগে ছিলেন ময়মনসিংহে। লিখেছেন বহুলপঠিত বিখ্যাত কবিতা, ২৫ লাইনের:

তেলের শিশি ভাঙল বলে

খুকুর পরে রাগ করো।

তোমরা যে সব বুড়ো খোকা

ভারত ভেঙে ভাগ করো!

তার বেলা?

(খুকু ও খোকা ১৯৪৭)

এই কবিতার উৎস ছোট কন্যা তৃপ্তি রায়। তৃপ্তির বয়স যখন দুই। বাবার জন্য তেলের শিশি (জবা কুসুম তেলের শিশি) নিয়ে, ওই বয়সে, খেলতে-খেলতে যাওয়ার সময় হাত থেকে পড়ে যায়। ভাঙে।

অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়ের পাঁচ সন্তানের তিন সন্তানেরই জন্ম পূর্ববঙ্গে। মধ্যম সন্তান চিত্রকাম পাঁচ-বছর বয়সে মারা যান, চট্টগ্রামে, কৈবত্যধামে চিত্রকামের স্মরণে ফলকও আছে।

অন্নদাশঙ্করের বন্ধুকুলে বাংলাদেশের বহু সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, গুণীজন। বন্ধু নয় কেবল, আত্মীয়তায় একাত্ম। বন্ধু আবুল ফজলকে তিনিই বুদ্ধিদাতা, ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গল্প লিখুন।’ লিখেছেন। আবুল ফজলের স্মৃতিচারণ গ্রন্থে অন্নদাশঙ্করের নানা বিষয় উল্লেখিত।

আমাদের এও জানা আছে, দেশ ভাগ না হলে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অন্নদাশঙ্কর বসতি গড়ার পরিকল্পনা পোক্ত করেছিলেন। লিখেছেনও তিনি। তাঁর একটি গ্রন্থের নাম ‘আমার ভালোবাসার দেশ।’ এই দেশ বাংলাদেশ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের জন্ম ১৫ মার্চ ১৯০৪ সালে, ওড়িশার দেশিয় রাজ্য ঢেঙ্কানালে। শাক্ত পরিবারে। বাবা নিমাইচরণ রায়, মা হেমনলিনী। শাক্ত থেকেই বৈষ্ণব।

বৈষ্ণবতায় নরনারীর যে লীলা, প্রেম, ঈশ্বরপ্রেমে সব মানুষ একাত্ম। ধর্ম গৌণ। ধর্মীয় আবদ্ধতা লাগামছাড়া। সহজিয়া মানবতাই মুখ্য। যেমন লালনের গানে। লালন হিন্দু না মুসলিম গৌণ। ঈশ্বর ভজনা মানবপ্রেমই সার্বিক। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের বালাই নেই। এই যে অ-বালাই, অন্নদাশঙ্কর পারিবারিক মনমানসেই জেনেছেন। শৈশবেই। তার মানবপ্রেমবোধে মানুষ-ই সবার উপরে, ‘তাহার উপরে কেহ নাই।’ ধর্ম, ধর্মাচরণ যাইহোক মানবিকতায় মানবতন্ত্র। বৈষ্ণব চেতনা থেকেই লিখতে পারেন, ‘জাতপাত, সম্প্রদায়, ধর্ম তুচ্ছ। যদি মানবিক হই, মানবতাই প্রথম। খাদ্যের জাত নেই। সাতদিন এক টেবিলে একসঙ্গে বসে খেলেই, খাওয়া ভাগাভাগি করলে, একই চামচে খাদ্যের গুণেই আমরা হিন্দু-মুসলিমরা নিবিড়, ঘরোয়া। আত্মীয়।

আরো একটি মারাত্মক কথা বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, হোক তা হিন্দু মুসলিম, মানুষই হত্যা নয়, বিদ্বেষ নয়, মনুষ্যত্ব, মানবিকবোধও হত্যা।’ দেখতেই পাচ্ছি, ভারতসহ পৃথিবীর নানা দেশে।

ভারতের সাম্প্রদায়িক চরিত্র কী হতে পারে ভবিষ্যতে, আগামবার্তা ছিল তাঁর লেখায়। প্রোফেসি। হুবহু মিলে যাচ্ছে। নানা দিক থেকে মিলিয়ে দেখছি, তাঁর জন্মদিনে প্রাক্কালে মনীষীর দিব্যদৃষ্টি ঠিক, সত্য।

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব (চিফ সেক্রেটারি) রথীন সেনগুপ্তের কাছে শুনেছি, অন্নদাশঙ্করকে হত্যার জন্যে আরএসএস ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে দিনক্ষণও ঠিক করে। গোয়েন্দা মারফত এই গোপন সংবাদ জেনে অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন। কড়া নিরাপত্তা। দেখেশুনে অন্নদাশঙ্কর বলেন, ‘মারুক, শহীদ হবো। ফোনে আমাকে ডাকেন, যাই। হেসে শোনান, বুড়ো বয়সে শহীদ হওয়া গৌরবের।’

অন্নদাশঙ্করের বৈশ্বিক মানবিকতা পরিবার থেকে, নিজের দায় থেকেও। স্ত্রী মার্কিনি, টেক্সাসের এল পাসোর অ্যালিস ভার্জিনিয়া ওরনডোর্ফ (আদি দক্ষিণ জার্মানির), বিয়ের পরে লীলা রায় নামকরণ।

অন্নদাশঙ্কর বৈষ্ণব হিন্দু, স্ত্রী প্রোসেট্রেস্টান্ট খ্রিস্টিয়ান, যুক্ত হলুম পরিবারে, মুসলিম নামধারী। একই বাড়িতে, একই টেবিলে থাকা, খাওয়া। মানবিকতার আদর্শ।

আমাদের পরিবার তাঁরও পরিবার। ঢাকা থেকে আত্মীয়-স্বজন এসে তাঁর গৃহে অবস্থান। ঢাকায় গিয়ে তিনিও আমাদের পারিবারিক।

অন্নদাশঙ্কর রায় খাঁটি বাঙালি, ভেজাল নেই। আত্মজীবনীতে বিস্তারিত। কিন্তু তাঁর প্রথম সাহিত্য ওড়িয়া ভাষায়। কবিতা। ওড়িয়ার পাঁচজন লেখক, এরমধ্যে দুজন বাঙালিও, ওড়িয়া আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃত। ‘সবুজ দল’ নামে (প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ প্রেরণাদায়ক) আত্মপ্রকাশ।

অন্নদাশঙ্কর বলেন, এই প্রকাশে রবীন্দ্রনাথই মূল প্রেরণা।’

বাংলার আধুনিক সাহিত্যে, বুদ্ধিমননতায় অন্নদাশঙ্কর বহুমান্য, সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ উচ্চকণ্ঠিত।

অন্নদাশঙ্করের গদ্য বাংলা সাহিত্যের সম্পদ, বলেছেন সাহিত্যের পণ্ডিতকুল। ছড়ায়, কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর ভাষ্যঃ ‘রাজা’। কত রকম ছড়া। ছোটদের। বড়োদের।

বাংলাদেশ প্রেমিক অন্নদাশঙ্কর। এই প্রেম বাংলাদেশের জলমাটি হাওয়া নিসর্গে উজ্জীবিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখেন (১৯৭১-এ)-

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা

গৌরী মেঘনা বহমান

ততদিন রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান

(অংশ ‘বঙ্গবন্ধু।’ ১৯৭১)।

অন্নদাশঙ্কর দুই বাংলার, বিচ্ছিন্ন করা মুশকিল। তাঁর জন্মদিনে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, ভারত-বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।

যতদিন যাবে তিনিই রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলাদেশে স্মরণীয়। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ মাত্র, তিনি আমাদের চিন্তাচেতনায় আজকের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, সার্বিক বোধে।

বাঙালি তাঁর কাছে ঋণী। ঋণ অপরিশোধ্য।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
সবজির বাজার ঊর্ধ্বমুখী, তীব্র গরমকে দুষছেন বিক্রেতারা
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
ইমরান খান ও বুশরা বিবিরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা না বলতে আদালতের নির্দেশ
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
বিতর্কিত আউটের ছবি পোস্ট করে মুশফিক লিখলেন...
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ