আগেই বলেছি, দল নয়, জোট নয়; জিতেছেন মোদি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে নির্বাচন ঐতিহ্যবাহী সংসদীয় স্টাইলে হলেও কার্যত হয়েছে প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকশন; আরও নির্দিষ্ট করে বললে, হয়েছে আসলে গণভোট। মোদি হ্যাঁ, মোদি না। কারণ, নির্বাচনে মোদির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বিজেপি জিতলে মোদি প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু বিজেপি হারলে, কে জিতবে, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন; তার কোনও জবাব কারও কাছে ছিল না। মমতা বলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন, মায়াবতী চেয়েছিলেন দিল্লির মসনদ দখল করতে, কেউ কেউ ভেবেছেন বংশপরম্পরায় রাহুল গান্ধীই হবেন প্রধানমন্ত্রী। সবাই সুখস্বপ্নে বিভোর থাকলেও মোদিকে ঠেকাতে জাতীয় কোনও জোট করতে পারেননি। কিছু আঞ্চলিক জোট হলেও তা মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো ছিল না। বরং ছন্নছাড়া বিরোধী দল মোদিকে আরও নির্ভার করেছে, আরও গতি দিয়েছে মোদির জয়রথে। তবে এটা ঠিক, বিজেপি এককভাবে ২৭২ আসনের কম পেলে দলের ভেতরের-বাইরের খেলোয়াড়রা মোদিকে ঠেকাতে মাঠে নামতে পারতো। কিন্তু ক্যারিশমেটিক মোদি কাউকে সে সুযোগই দেননি। বরং মোদি ম্যাজিকে ভর করে বিজেপি আবার ক্ষমতায়।
মোদির বর্তমান উজ্জ্বল, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর; কিন্তু অতীত বড় কালিমালিপ্ত। ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গায় মূল উসকানিদাতা নরেন্দ্র মোদিকে একসময় ‘গুজরাটের কসাই’ বলা হতো। সেই কসাই এক যুগের ব্যবধানেই দেশের প্রধানমন্ত্রী বনে যান। নেতৃত্ব মানুষকে বদলে দেয়, মোদিকেও দিয়েছে। অন্তত গত পাঁচ বছরে কোনও দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু মোদি তার বেসিক বদলাননি। এখনও কট্টর হিন্দুত্ববাদই তার ক্ষমতার উৎস, নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার অস্ত্র। নিজের বেসিক ঠিক রাখতে গিয়ে ভারতের বেসিক বদলে দিয়েছেন মোদি। ২০০ বছরের শাসন শেষে ১৯৪৭ সালে ফিরে যাওয়ার আগে ব্রিটিশরা ভারতকে ভাগ করে দিয়ে যায়। পর পর দুদিনে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান সাম্প্রদায়িকতা আর সামরিক কর্তৃত্বে চলতে চলতে ব্যর্থ রাষ্ট্রের তকমা পায়। আর পাশাপাশি ভারত উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে বিকশিত হয়। মর্যাদা পায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। ভারত বহু মত, বহু পথের এক মিলিত ধারা। ২০১৪ সালে মোদির হাত ধরে বিজেপির নব উত্থানে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের মৌলিকত্বে টান পড়ে। এবার নির্বাচনে গণতান্ত্রিক চরিত্রের মৌলিকত্বেও আঘাত লেগেছে। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির গত ২২ মে মানে ফলাফল ঘোষণার আগের রাতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, এবারের নির্বাচন ভারতের আত্মার জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ভারতের আত্মা বলতে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, বহুত্ববাদের মৌলিকত্বকেই বুঝিয়েছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তি নরেন্দ্র মোদির প্রবল প্রত্যাবর্তনে ভারতের সেই আত্মার পরাজয় ঘটেছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, মোদির জয়েই ভারতের আত্মার পরাজয় ঘটেছে। এমনকি মোদি হারলেও পরাজয়ই ঘটতো। ভারতের আত্মা আসলে অনেকদিন ধরেই ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। এই যেমন এবারের নির্বাচনের সময়টুকু খেয়াল করুন। ছন্নছাড়া বিরোধী দলের কারণে মোদির না জিতে উপায় ছিল না। কিন্তু জেতার জন্য তিনি সাম্প্রদায়িকতাকে তো ব্যবহার করেছেনই, ব্যবহার করেছেন সামরিক জোশও। নির্বাচনি প্রচারণায় এত ঘৃণা, এত অনাস্থা, অবিশ্বাস আগে কখনও দেখা যায়নি। নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আগে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি, এবার উঠেছে। নির্বাচনি প্রচারণায় প্রতিপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে শত্রুজ্ঞানে আক্রমণ হয়েছে। মোদি অনেকদিন ধরেই কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার সংকল্পের কথা বলছেন। এই নিশ্চিহ্ন করার সংকল্প ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে বড্ড বেমানান। নির্বাচনি প্রচারণা থেকে কলকাতায় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। কিন্তু সেই মূর্তি ভাঙা বিজেপিই পশ্চিমবঙ্গে এবার বিপুল বিক্রমে ঢুকে গেছে। কারণ, রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের মূর্তি অনেক আগেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। নইলে মমতাকে ঠেকাতে পশ্চিমবঙ্গে বামরা তলে তলে বিজেপিকে আমন্ত্রণ জানায়! বামদের যেটুকু ভোট তা গেছে বিজেপির বাক্সে। তাতে বিজেপি ফাল হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকলো আর বামরা সুচ হয়ে হারিয়ে গেলো। ভারতের রাজনীতিতে বামদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটা এবার সেরে ফেলতে পারেন।
এটা ঠিক, প্রক্রিয়া যেমনই হোক, জনগণই ভোট দিয়ে মোদিকে ক্ষমতায় এনেছেন। তবে বিশ্বে চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো এই জনরায়। এখনও ঠিক জানি না, বিজেপি ৪০ শতাংশের আশপাশে ভোট পেয়েছে। তার মানে ৬০ ভাগ মানুষ কিন্তু বিজেপির বিপক্ষে। আর ৪০ শতাংশ মানুষের রায় নিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও মোদি কিন্তু আগামী পাঁচ বছর স্বৈরাচারী শাসনের লাইসেন্স পেয়ে গেলেন। তবে সাধারণ মানুষ এখন আর এসব পরোয়া করে না। আদর্শের বুলি কপচানোর দিন বুঝি শেষ। মানুষ এখন উন্নয়ন আর স্থিতিশীলতা পেলেই খুশি। মোদি তাদের সে নির্ভরতা দিতে পেরেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ভারতের স্থিতিশীলতার সুফল বাংলাদেশও পাবে। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ মহলে অস্বস্তি ছিল, উল্লাস ছিল বিএনপি শিবিরে। কিন্তু দ্রুতই বিএনপি হতাশ হয়, অস্বস্তি কেটে যায়। পারস্পরিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে পারস্পরিক সুসম্পর্কের গুরুত্বটা দুপক্ষই বুঝতে পেরেছে। তাই বিজেপির সময়ই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়। মোদির প্রবল প্রত্যাবর্তনে সে সম্পর্ক আরও উষ্ণতা পাবে নিশ্চয়ই। তবে আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে বিজেপির যে রণহুঙ্কার, তাতে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে হবে। বিজেপি যদি নিছক নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য এ হুঙ্কার দিয়ে থাকে, তাহলে নিন্দা জানালেও চলবে। কিন্তু বিজেপি যদি বাঙালি মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিয়ে ঝামেলা করে তাহলে কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। তেমনটা আশা করি কেউই চাইবেন না। স্থিতিশীলতার আরামটা দুইপক্ষই উপভোগ করছেন।
তবে রাজনীতিশূন্যতার সমস্যাটা নিছক বাংলাদেশ বা ভারতের নয়। গোটা বিশ্বেই অপরাজনীতি, কট্টর ডানপন্থা, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ, কট্টর জাতীয়তাবাদ, নির্বাচিত স্বৈরাচারের উত্থান ঘটছে। ভালো সময়-খারাপ সময় সভ্যতার বিবর্তনের একেকটি ঢেউ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেশে দেশে ভালো সময়ের ঢেউ লেগেছিল। এই সময় নানান বিপ্লব হয়েছে, মহৎ লড়াই হয়েছে। উদার, মানবিক বিশ্ব গড়ার চেষ্টা হয়েছে। একা এগোনো নয়, সবাইকে নিয়েই এগোনোর প্রত্যয় ছিল সবার মধ্যেই। কিন্তু নব্বই দশক থেকেই যেন ভালো সময়ের ঢেউ ভেঙে খারাপ সময়ের ঢেউ লেগেছে। সেই ঢেউ এখন তুঙ্গে। ব্যক্তি মোদিকে দুষে লাভ নেই। এই ঢেউয়ের প্রভাবে হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও প্রত্যাবর্তন ঘটবে। তবে নিশ্চয়ই খারাপ সময়ের ঢেউ ভেঙে আবার ভালো সময়ের ঢেউ আসবে। আসবেই। অন্ধকার কখনও চিরস্থায়ী হয় না। সেই যে সুমন চাটুজ্যে গেয়েছিলেন, সন্ধ্যে নামার সময় হলে/পশ্চিমে নয়, পূবের দিকে/মুখ ফিরিয়ে ভাববো আমি, কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ