-
ফিরে আসি পশ্চিমবঙ্গের আগামী দিনের রাজনীতিতে। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে মনে পড়লো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত রবীন্দ্র অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় ঘোষের কথা। ড. ঘোষ খুবই একজন উঁচুমাত্রার পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর স্ত্রী নন্দিতা ঘোষ ছিলেন বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদের ছোটবোনের মেয়ে। একসময় কলেজে শিক্ষকতা করতেন। বাল্যকাল কেটেছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে একটি উপন্যাস লিখেছেন ‘উত্থাল যৌবন’ নামে। নিঃসন্তান ড. ঘোষ দম্পতি থাকতেন কলকাতার মানিকতলায় একটি দুই বেডরুমবিশিষ্ট সরকার থেকে পাওয়া ফ্ল্যাটে। রাজনৈতিকভাবে সিপিএম’র সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অবসরের পর সিপিএম’র মুখপত্র ‘গণশক্তি’র সাহিত্য ও ফিচার পাতা সম্পাদনা করতেন। ড. ঘোষ একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল গবেষণা কেন্দ্রে বক্তৃতা দিয়েছেন। তার এমন একটি বক্তৃতা ‘নজরুলের ঠিকানা’ নামে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশ করেছে। স্বামী স্ত্রী কয়েক বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন। এর পরপরই তাঁদের সেই ফ্ল্যাট জবরদখল হয়ে গেছে। জীবিত থাকতে যখনই কলকাতা গিয়েছি তখনই ড. ঘোষের বাসায় গিয়ে আড্ডা দিয়েছি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর কলকাতা গেলে ড. ঘোষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গ আর ভারতের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হয়। জানতে চাই, তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পরতো বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। মমতা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? ড. ঘোষ কোনও চিন্তা না করেই বললেন, মমতা যদি ঠিকমতো রাজ্য শাসন করতে আর বামফ্রন্টের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারেন, তাহলে কমপক্ষে দুই মেয়াদে দশ বছর। তিনি আরও মন্তব্য করেন, এই রাজ্যে কংগ্রেস আর কখনও ক্ষমতায় ফিরবে না। বামফ্রন্টের ব্যাপারে ড. ঘোষ তখনও কিছুটা আশাবাদী। মমতা রাজনীতিতে ওঠে এসেছেন কংগ্রেস থেকে। প্রথমে যুব কংগ্রেস, পরে মূল কংগ্রেস। কংগ্রেস হতে তিনি দু’বার রেলমন্ত্রী, একবার কয়লামন্ত্রী, একবার যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দলের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি কংগ্রেস থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন। তখন পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট ক্ষমতায়। মমতা খুবই উচ্চাভিলাষী এবং রাজপথের রাজনীতিতে বেশ পারঙ্গম। অনেকে বলেন তার রাজনীতি নাটকে ভরা। মিছিলে পুলিশের সঙ্গে একটু ধস্তাধস্তি হলে তিনি নিজের ব্লাউজ নিজে ছিঁড়ে মিডিয়ার সামনে গিয়ে পুলিশ তার ব্লাউজ ছিঁড়েছে বলে একাধিকবার অভিযোগ করেছেন। বৃহস্পতিবার মোদির শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে মমতা জানালেন তিনি শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এটি তার দায়িত্ব। কিন্তু দিন না ফুরাতেই ঘোষণা করলেন তিনি অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কারণ, নির্বাচনের সময় তার দলের যারা বিজেপি’র হাতে নিগৃহীত হয়েছেন তারা এবং যারা নিহত হয়েছেন তাদের স্বজনরা নাকি চান না তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।
শুরু হতেই মমতা যত না একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আচরণ করেছেন, তার চেয়েও তিনি ছিলেন একজন কর্তৃত্ববাদী মহিলা। কলকাতার কোথাও গেলে মনে হবে না এই শহরে মমতা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনও রাজনৈতিক নেতা আছেন। পোস্টার বলি বা বিলবোর্ড অথবা বাসস্ট্যান্ড, শুধুই মমতা আর মমতা। শুরুতেই ঠিক করেছিলেন রাজ্যের রঙ হবে নীল। ভবন বলি আর ল্যাম্পপোস্ট, সব জায়গায় নীল রঙ। একবার ঘোষণা দিলেন মূল সড়কের সব বাড়ির দেয়ালে নীল রঙ লাগাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের ২৭ শতাংশ মানুষ মুসলমান (দুই কোটি ৪৬ লক্ষ)। মমতার ধারণা, এরা তার অমূল্য ভোট ব্যাংক, সুতরাং তাদের তোষামোদ করার জন্য যা যা করা দরকার তিনি তা-ই করবেন। ২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি ঘোষণা করলেন উর্দু হবে পশ্চিমবাংলার দ্বিতীয় ভাষা। ইংরেজি আর বাংলা ইতোমধ্যে এখানে দাফতরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, কিন্তু রাজ্যসভায় ঘোষণা দিয়ে কখনও আর কোনও ভাষাকে এমন মর্যাদা দেয়া হয়নি। পশ্চিমবাংলার মুসলমানরা এমনিতে একটু পাকিস্তান ঘেঁষা বলে সাধারণ মানুষ মনে করেন। তবে ব্যতিক্রম আছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের বেশিরভাগই সব সময় পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যখন যুদ্ধাপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো তখন কলকাতার মুসলমানরা তার প্রতিবাদেও একটি মিছিল বের করলো। আর যখন এই আদেশের পক্ষে বাঙালিরা প্রতিবাদ মিছিল বের করতে চাইলো তখন তাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের লাগোয়া সীমান্তবর্তী এলাকার জেলাগুলোতে জনসংখ্যার দিক থেকে গোঁড়া মুসলমানের সংখ্যা বেশ উল্লেখযোগ্য, কোনও কোনও ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশেরও বেশি। এদের অনেকের বাড়িতে টিভি নিষিদ্ধ। সন্ধ্যার পর পরই সেখানে বেশিরভাগ বাড়িতে ক্যাসেটে সাঈদীর ওয়াজ বাজানো হয়। এসব জেলায় সব সময় কংগ্রেস আর সিপিএম ভালো করেছে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে এই অঞ্চলে প্রথমবারের মতো বিজেপি ভালো করেছে এবং আসন পেয়েছে। প্রাপ্ত মোট ভোটের ৩৪ শতাংশ বিজেপির বাক্সে গেছে। মালদাহের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। এই জেলার আবু বারকাত গনি খান চৌধুরী একজন প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ । মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে ডাকে বারকাত দা হিসেবে। আজীবন কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় তিনি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করার সময় কেন্দ্রের রেল বাজেট থেকে অর্থ এনে কলকাতার মেট্রোরেল ও সার্কুলার রেল চালুর ব্যবস্থা করেছিলেন। মালদাহের উন্নয়নের জন্য বাড়তি বরাদ্দ এনে তিনি তার জেলার চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পরিবার থেকে যে-ই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তিনি বিজয়ী হয়েছেন। এবার প্রথমবারের মতো গনি খান চৌধুরী পরিবারের মেয়ে মৌসুমী নূর তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে বিজেপি’র খগেন মুরমুরের কাছে প্রায় আশি হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছেন।
প্রবাদ আছে ডুবন্ত জাহাজ থেকে জান বাঁচানোর জন্য ইঁদুরও লাফিয়ে পড়ে। তৃণমূলে ইতোমধ্যে তা শুরু হয়েছে। একসময় মুকুল রায় মমতার দক্ষিণহস্ত হিসেবে গণ্য হতেন। মনমোহন সিংয়ের আমলে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তৃণমূল গঠন করে রেলমন্ত্রী হিসেবে মমতা ইস্তফা দিলে মমতার অনুরোধে মুকুল রায়কে রেল মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনিও পরে তৃণমূলে যোগ দেন। সেই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোট ইইপিএ’র সদস্য। সেই মুকুল রায় তৃণমূল ছেড়ে ২০১৭ সালে যোগ দিলেন বিজেপি’তে। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে তৃণমূলের ভরাডুবির পর এখন শুরু হয়েছে বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল থেকে নেতাকর্মীদের পদত্যাগ করে বিজেপি’তে যোগ দেওয়ার হিড়িক, যার মধ্যে রাজ্য তৃণমূল থেকে নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভার সদস্যরাও আছেন। সর্বশেষ তৃণমূল থেকে যোগ দিয়েছেন মনিরুল ইসলাম। তিনি-সহ এরইমধ্যে তিনজন তৃণমূল বিধায়ক (বিধানসভার সদস্য) বিজেপিতে যোগ দিলেন। এর আগে তৃণমূল থেকে নির্বাচিত ৫০ জন কাউন্সিলর (ওয়ার্ড কমিশনার) বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। সব আলামত দেখে এটি মনে হওয়া স্বাভাবিক মমতার জাহাজ ডুবছে। তার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তাহলে সেই দায় নিজের কাঁধেই নিতে হবে। কারণ, তিনি দল গঠন করেছিলেন কিন্তু দলের কোনও কাঠামো গড়ে তুলতে চেষ্টা করেননি। তিনি মনে করতেন তিনিই দল এবং তিনিই সর্বময় কর্তা। কিছু সময়ের জন্য রাজনীতিতে নাটক করা যায় কিন্তু নাটক দিয়ে খুব বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায় না। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। এই লেখা লেখার আগে পশ্চিমবঙ্গের অনেক রাজনীতি সচতেন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ জোর দিয়ে বললেন না সেই নির্বাচনে তৃণমূল আবার ফিরবে। বিজেপি যদি ২০২১ সালে সরকার গঠন করে তা যে খুব ভালো কিছু একটা হবে তাও কিন্তু নয়। বিজেপি’র পাণ্ডাদের হাতে প্রথম শিকার হওয়ার সম্ভাবনা আছে রাজ্যের মুসলমান আর দলিতরা। সম্ভাবনা আছে দীর্ঘ সময়ের জন্য পশ্চিমবঙ্গ একটি রাজনৈতিক সংকটে পড়ে যাওয়ার। আর ২০১১ সালে মমতা বিজয় লাভ করার পর মনে হয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত সমস্যা আছে, বিশেষ করে তিস্তাসহ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন বিষয়গুলোর সমাধান হবে। তা তো হয়ই নি, বরং না হওয়ার জন্য মমতা যেসব খেলো অজুহাত দিয়েছেন তা ইতোপূর্বে অন্য কেউ দেননি। তিনি শুধু তাঁর নিজ দেশের দু’জন প্রধানমন্ত্রীকে অস্বস্তিতে ফেলেন নি, যে শেখ হাসিনা তাঁকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করতেন তিনি তাঁকেও বেশ অবজ্ঞা ও হতাশ করেছেন। একটা ঘটনা বলে লেখাটা শেষ করি। গত বছর রমজান মাসে শেখ হাসিনা বিশ্বভারতীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধন করতে গেছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী। সঙ্গে আছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল আর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মমতা ফটোসেশনে থাকতে একটু সংকোচ বোধ করছিলেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শেখ হাসিনা মমতাকে অনেকটা বগলদাবা করে তাঁর পাশে দাঁড় করালেন। একবার এক ভারতীয় সাংবাদিক আমার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, অনেক প্রধানমন্ত্রীর সফর কভার করেছি, অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি কিন্তু এদের মধ্যে শেখ হাসিনা একেবারেই ব্যতিক্রম। আজ খুব স্বর্গত ড. জ্যোতির্ময় ঘোষের কথা মনে পড়ছে। তার বেঁধে দেয়া মমতার দশ বছরের সময়সীমা বোধহয় শেষ হয়ে আসছে। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সবাইকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা ।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক