X
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

নগরের তীব্র উত্তাপ কি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মনকে ছুঁতে পারে?

ড. রাশেদা রওনক খান
২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:০০আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৪৩

কয়েকটি প্রশ্ন রেখেই শুরু করতে চাই– সারাক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে যারা থাকেন সেসব নীতিনির্ধারকরা কি শহরের এই অস্বাভাবিক উত্তাপ টের পান? এভাবে কি একটি দেশের রাজধানী শহর গড়ে উঠতে পারে? আসলেই বিষয়টি নিয়ে ভাবেন? যদি ভাবতেন তাহলে কি শহরটির চিত্র বা পরিবেশ এমন থাকতো? শহরটিকে কংক্রিটের কারা এবং কীভাবে বানিয়ে ফেললো? এখন তাহলে আমাদের  সামনে সমাধান কী?

একটি শহরের পরিবেশগত ভারসাম্য রাখার জন্য যে পরিমাণ সবুজ এলাকা, গাছ, জলাশয়, খোলা উদ্যান থাকা জরুরি, এই কংক্রিট আচ্ছাদিত শহরের এসবের অনুপস্থিতিতে যে বেহাল অবস্থা বিদ্যমান, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কিন্তু কেন এই বেহাল দশা? পৃথিবীর প্রতিটি দেশে নীতিনির্ধারকরা নগর পরিকল্পনায় নগর– পরিকল্পনাবিদদের মতামতকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেন, অথচ আমাদের এখানে কি হয়?

যেখানে নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, একটি শহর  আদর্শ তখনই হয়ে ওঠে যখন এর প্রায় ১০-১৫ শতাংশ এলাকা জলাশয় ও ১৫-২০ শতাংশ এলাকা সবুজে আচ্ছাদিত থাকে। অথচ আমাদের শহরে গত দুই দশকে খোলা জায়গার পরিমাণ তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে, বিষয়টি কতটা উদ্বেগের, ভাবুন তো?

যারা শহরের জলাভূমি ও মাঠ দখল করে একের পর এক ভবন বানিয়ে চলছে, তাদের অনেকেই  সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী বলে থাকেন। এই ভূমিদস্যুদের প্রচ্ছন্ন প্রভাবেই ড্যাপ বা ঢাকা ডিটেলস এরিয়া প্ল্যান কার্যকর হতে পারে না।

শহরের মোট ভূমির মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ খোলা জায়গা হিসেবে টিকে আছে, তাও কয়দিন থাকবে সন্দেহ আছে। ভূমিদস্যুদের চোখ নিশ্চয়ই বাকি এই অংশগুলোতেও। অথচ নগর-পরিবেশ নিয়ে গবেষণায় বলা হয়ে থাকে যে একটি আদর্শ নগরে প্রতিটি মানুষের জন্য ৯-৫০ বর্গমিটার সবুজ এলাকা প্রয়োজন। তাহলে আমরা কতটা অসহায়ভাবে বসবাস করছি?

১৯৯৯ সালে কংক্রিটের আচ্ছাদন যেখানে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এলাকায়, বর্তমানে ঢাকায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ মোট ভূমির প্রায় ৮২ শতাংশ। শহরজুড়ে গড়ে উঠছে কংক্রিটের ভবন, যেখানে এসব দালানের আড়ালে ঢাকা পড়ছে কেবল আকাশ নয়, মানুষও। শহরজুড়ে মানুষ আর মানুষ, কিন্তু তবু আজ আর মানুষ মানুষকে ছুঁতে পারে না এই শহরে।

এই যে সমাজে-সংসারে-শহরে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে, তার পেছনেও আছে এই কংক্রিটে ঢেকে যাওয়া পরিবেশ, যেখানে জীবন হয়েছে যান্ত্রিক, মনমানসিকতা হয়েছে সংকীর্ণ, ঠিক এক কংক্রিটের সানশেড থেকে আরেক বাড়ির সানশেডের সুতো পরিমাণ দূরত্বের মতো।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী কী করা যেতে পারে? শহরকে এই হিট ওয়েভ থেকে রক্ষার জন্য এত আলাপ, এত হাহাকার, এত এত সভা-সমাবেশ- বক্তৃতা করেও কি কোনও লাভ হয়েছে? এই যে বলা হচ্ছে, শহরের চারপাশে সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা দরকার, তা কি করা সম্ভব হচ্ছে?

শহরজুড়ে যে কয়টা জলাশয় এখনও টিকে আছে, তাদের সংরক্ষণ কতটা সম্ভব কিংবা কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক? আর দখলকৃত জলাশয় পুনরুদ্ধার করবে কে? এগুলো কি আর পুনরুদ্ধার হবে না?

শহরের দিকে ধাবমান অভিবাসিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাস করতে সরকার কতটা বিকেন্দ্রীকরণের দিকে মনোযোগী হচ্ছে? শহর পরিষ্কার রাখার দায়িত্বে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কি দায়িত্ব পালন করছেন সর্বোচ্চ লেভেলের? শহরের জলাশয় ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের কোন অফিস দায়িত্বে আছেন? এসব দায়িত্বের কি সুষম বণ্টন হয়েছে, মানে ওয়েল ডিফাইন্ড?

এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় চিফ হিট অফিসার ও তার দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে। বাংলাদেশে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রায় এক বছর হলো। কিন্তু তার কাজ কী, এই বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কোনও গাইডলাইন, কাজের ক্ষেত্র ও ক্ষমতা কি সিটি করপোরেশন তাকে দিতে পারছে? বাংলাদেশ ছাড়া হিট অফিসারকে নিয়ে এভাবে আর কোথাও ট্রল করা হচ্ছে? আসলে কারণটা কী?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে একটু জেনে নিই একজন হিট অফিসারের ভূমিকা কী? কেন একজনকে এই হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়? একজন হিট অফিসারের পক্ষে কি আদৌ তাপমাত্রা কমানোর কোনও সুযোগ আছে?

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মাঝে ৩.৫ বিলিয়ন মানুষ হিট ওয়েভের শিকার হবে, যার অর্ধেক শহরে বসবাসকারী মানুষ হবে। Arsht-Rock এই সমস্যার সমাধানকল্পে চিফ হিট অফিসার একটি পদ সৃষ্টি করে, যার কাজ হবে স্থানীয় সরকারকে শহরগুলোর তাপমাত্রা কমানো বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করা।

আমার মতে, ট্রল হওয়ার পেছনে কেউ বলছেন, তিনি নারী। বাংলাদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীরা ‘চিফ’ হয়ে কাজ করছেন, এই ক্ষেত্রে এটা বেশ খোঁড়া যুক্তি এবং জেন্ডার কার্ড খেলার এখানে কোনও সুযোগ নেই। কেউ কেউ বলছেন, মেয়র কন্যা, সেই কারণে। আজকে তিনি মেয়রকন্যা না হয়ে মেয়র পুত্র হলেও হয়তো এভাবেই ট্রলের শিকার হতেন, হয়তো ট্রলের ধরন ও ভাষা ভিন্ন হতো।

অনেক সময় জনপ্রতিনিধিরাও তাদের কার কী কাজ, কাজের সীমানা নির্ধারণ করতে পারেন না, কলোনিয়াল আমলাতান্ত্রিক জটিলতার লিগ্যাসি ধারণ করার কারণে। যেকোনও কাজের ক্ষেত্রে একটি সেক্টরের নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারিত না হওয়ার কারণে নগর পরিচালনায় বিভিন্ন আন্তমন্ত্রণালয় জটিলতা বিরাজ করে। যেমন, রাস্তার বাতি লাগানোর মতো এবং রাস্তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত কিছু কাজ ছাড়া সিটি করপোরেশনের কাজের সীমানা কতটুকু পর্যন্ত তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল।

জলাশয় ও  জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কারা করবে, পুনরুদ্ধার কারা করবে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কারা করবে, এসব কাজ একটি নির্দিষ্ট অফিসের সুপারভিশনে নয়। ফলে, একটি কাজ আসলে কোন মন্ত্রণালয় নেতৃত্ব দেবে, তা সঠিকভাবে জানা নেই কারও। এই জটিলতার কারণে কাজটিতে কেউই দায়িত্ব নিয়ে নেতৃত্ব দিতে চায় না। ফলে, শেষ পর্যন্ত কাজটি আর সফলতার মুখ দেখে না। যেমন, ঢাকা শহরে একটি ভবন নির্মাণে ভূমির মাপ থেকে শুরু করে ইউটিলিটির সংযোগ পাওয়া পর্যন্ত কাজ করতে গেলে দেখা যায়, এখানে রাজউক, ঢাকা মেট্রোপলিটনের প্রশাসনিক দফতর, বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিস অফিস, এবং সিটি করপোরেশনের মাঝে বহুপাক্ষিক জটিলতা দেখা দেয়।

কিছু দিন আগে বেইলি রোডে আগুন লাগার ঘটনার পর আমরা দেখতে পেলাম কীভাবে রাজউকসহ বিভিন্ন অফিস একে-অপরকে দোষারোপ করতে শুরু করলো। আর এই কারণে নগরের বিভিন্ন সেক্টরের কাজগুলোতে অসঙ্গতি থেকে যায়। শহরের অনেক সেক্টরে সিটি করপোরেশন পরিপূর্ণভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন কাজটি করার জন্য। যেমন, ২০২৩ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নতুন ১৮ ওয়ার্ডের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নে ৩ কোটি টাকা খরচ করেছে, যদিও আইনগত ক্ষমতা না থাকায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ করতে পারছে না তারা। তাহলে যেখানে শহরের মেয়র/ সিটি করপোরেশন স্বয়ং তাদের কাজের সীমানা নির্ধারণে সমস্যায় পড়ে, সেখানে একজন চিফ হিট অফিসারের পক্ষে এই ধরনের সমস্যায় পড়ার অবকাশ থাকতেই পারে।

তাপমাত্রা কমাতে আমাদের সবার দায়িত্ব আছে, তবে সরকারের ওপর দায়িত্ব বর্তায় সবচেয়ে বেশি। এবং নগরকে জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন করতেই হবে, এর কোনও বিকল্প নেই। কিছু সুপারিশ রাখা যেতে পারে:

১. শহরের চিফ হিট অফিসার যদি এলাকাভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক সবুজ এলাকা গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেকটি এলাকায় গিয়ে এলাকাবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার কিছু পরিকল্পনা হাতে নিতেন তাহলে অনেকটাই কাজে লাগতো। এই কাজটি করতে তিনি সিটি করপোরেশনের সহযোগিতা নিতে পারেন অনায়াসে।

২. শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, জনঘনত্ব ও কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার বিদ্যমান বাস্তবতায় নতুন করে কংক্রিটের বিস্তৃতি না ঘটানোর জন্য বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিটি করপোরেশনগুলো যৌথ আয়োজনে কিছু কাজ করতে পারে। মেয়রগণ নিজেরা তো বটেই, নাগরিকদেরও অনুরোধ করতে পারেন শহরকে সবুজ করতে সহায়তা করার জন্য।

৩. ডেভেলপারদের ও বাড়িওয়ালাদের অবকাঠামোগত পরিকল্পনা প্রণয়নের আগে পরিবেশগত, প্রতিবেশগত, সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব পর্যালোচনা করতে বাধ্য করতে পারেন। নতুন বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে চারপাশে কিছুটা হলেও গাছ লাগানোর মতো জায়গা যেন রাখেন ভূমি মালিক, সেই ব্যাপারে সচেতনতামূলক কিছু কর্মসূচি হাতে নিতে পারেন সিটি করপোরেশনগুলো।

ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কতটুকু জায়গা খোলামেলা রাখতে হবে আর কতটুকু জায়গায় ভবন নির্মাণ করা যাবে- এই ধরনের সচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রম ভবন মালিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে করতে পারেন।

৪. এত হিট ওয়েভের মাঝে মানুষের রাস্তায় চলাচল কিছুটা হ্রাস করা যায়, সেজন্য সরকারি বেসরকারি অফিস-কারখানা-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে পারেন। মানুষ যেন স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারেন, সেজন্য কিছু উদ্যোগ নিতে পারে সিটি করপোরেশনগুলো।

৫. বিভিন্ন করপোরেট অফিস-হসপিটাল-ক্লিনিক- রেস্টুরেন্টের সামনের স্পেসটিকে সাধারণ মানুষের বিশ্রামের জন্য উন্মুক্ত রাখা এবং পথচারীদের পানি পান করার একটি ব্যবস্থা করতে পারেন।

এসব প্রাইভেট অফিসের স্পেস খুবই শ্রেণি সচেতন! শ্রেণি বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানাতে পারি আমরা সবাইকে। এমনকি তারা মানবিকতার জায়গা থেকে ঠাণ্ডা শরবত বা পানীয়র ব্যবস্থা করতে পারে।

৬. ঢাকা শহরের কোনও রাস্তা দুইপাশে গাছ লাগানো বাকি থাকবে না, সেই আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন বছর ব্যাপী।

৭. শহরে পার্ক, খেলার মাঠসহ পাবলিক প্লেসের সংখ্যা যেভাবে ভূমিদস্যুদের ভূমি দখলের মুখে হ্রাস পাচ্ছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা, দেনদরবার করা। পার্ক, খেলার মাঠসহ পাবলিক স্পেসগুলোতে সাধারণের জন্য ছায়া ও খাবার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা।

শেষ কথা হলো, নীতিনির্ধারকদের সাধারণের পক্ষ হয়ে ভাবতে হবে। ভূমিদস্যুদের পক্ষে, দুর্নীতিবাজদের পক্ষে থেকে কাজ করলে আমাদের আরও ভোগান্তির শিকার হতে হবে। আমাদের নীতিনির্ধারকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকেন বলে হয়তো তারা সাধারণের মনের কথা বুঝতে বেশিরভাগ সময় পারেন না। তাই আমাদের মনের কথা তাদের কাছে পৌঁছায় না, যেমন পৌঁছায় না এই দাবদাহের উত্তাপ। 

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দেশে প্রতি চার প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন
দেশে প্রতি চার প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন
কোরবানির জন্য কী পরিমাণ প্রাণী প্রস্তুত, জানালেন মন্ত্রী
কোরবানির জন্য কী পরিমাণ প্রাণী প্রস্তুত, জানালেন মন্ত্রী
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন, মির্জা ফখরুলকে নানক
ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন, মির্জা ফখরুলকে নানক
সর্বশেষসর্বাধিক