ঈদ শব্দের অর্থ খুশি, আনন্দ, অনুষ্ঠান বা উৎসব। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া ও জেরুজালেমে প্রচলিত ছিল ‘নবান্ন’ বা নতুন ফসলের উৎসব। এছাড়া সিরিয়া, ইরাক, জেরুজালেম, ইয়েমেন এসব অঞ্চলে শত শত বছর ধরে ‘নওরোজ’ এবং ‘মেহেরজান’ নামে দুটি উৎসব ভীষণ জনপ্রিয় ছিল, এখনও এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। ইরানে ‘নওরোজ’ উৎসব এখনও তুমুল জনপ্রিয়।
কিন্তু এই অঞ্চলে নবী হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর হিজরতের পর থেকে ক্রমশ রমজানে রোজা পালন এবং ঈদ উৎসব মুসলমানদের ভেতর সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঈদে মদিনায় বসবাসরত হাবসিরা (আবিসিনিয়া বা বর্তমান ইথিওপিয়ার একাংশের অধিবাসী) লাঠি খেলার আয়োজন করতো এবং নবীর স্ত্রী আয়েশার সেই লাঠি খেলা দেখার স্মৃতিও রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। নবী হজরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর আতর মাখা, সুন্দর ও পরিষ্কার পোশাক পরা এবং মিষ্টান্ন খাবারের উল্লেখ রয়েছে ঈদ উৎসবের একেবারে প্রথম দিকের দিনগুলোয়। কোরবানির ঈদের দিন তিনি কোরবানির পশুর মাংস দিয়ে প্রথম খাবার খেতেন। দুম্বা বা উটের মাংস দিয়ে রান্না করা খাবার গ্রহণ ও উৎসবের আঙিনায় নতুন গল্প সৃষ্টি বা কবিতা লেখা ছিল হাজার হাজার বছর ধরে বাস করে আসা আরব অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্য।
বাংলাদেশে (অবিভক্ত বাংলা ও পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ) ঈদ উৎসবের স্মৃতি খুবই অল্প দিনের। আমরা এখন যেভাবে ঈদ পালন করি, সেই অভ্যাস ক্রমশ গড়ে উঠেছে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে।
ঈদ পালনের যে যৎসামান্য বিবরণ পাওয়া যায় সেসব একেবারেই শাসক শ্রেণির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনের ১৯০ বছরে বিদেশি লেখক ও শাসকের স্মৃতিতে পূজা এবং জন্মাষ্টমীর যে মিছিল বা আয়োজনের কথা রয়েছে, সেখানে ঈদ পালনের কথা নেই বললেই চলে। হাতেগোনা তিন চার জনের স্মৃতি-লেখায় উল্লেখ আছে মহররমের মিছিল বা শোভাযাত্রার কথা।
১৬৪০ সালে ঢাকার ধানমন্ডিতে ঈদগাহ তৈরি করেন বাংলার সুবেদার শাহ সুজার অমাত্য মীর আবুল কাশেম। সাধারণ মানুষের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। আজও এই ঈদগাহের অংশবিশেষ রয়েছে ধানমন্ডিতে। বর্ণনায় আছে, ধানমন্ডির এই ঈদগাহ ছিল পাণ্ডু নদীর তীরঘেঁষে। এই পাণ্ডু নদী ধানমন্ডি হয়ে জাফরাবাদ (বর্তমান ফিজিক্যাল কলেজের পেছনের অংশ) ভেদ করে মিশে ছিল বুড়িগঙ্গার সঙ্গে! সেই বুড়িগঙ্গার খানিকটা সম্ভবত এখন বসিলা খাল। পাণ্ডু নদী পাণ্ডুর হতে হতে এখন স্মৃতি হয়ে গেছে।
মুঘলরা ভারতীয় মুসলিম ছিলেন না। তাই এই উপমহাদেশের মানুষের ধর্ম-কর্ম ও উৎসবের সঙ্গে তাদের প্রাণের যোগ তেমন তৈরি হয়নি। সম্রাট হুমায়ুন ও আকবর খানিক চেষ্টা করেছিলেন। সে সময়ে মানুষ সরাসরি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, শাসক ও শোষিত। ব্রিটিশদের সময়েও তাই। বাংলার প্রসিদ্ধ পীর-আউলিয়া যেমন শাহজালাল (র.), শাহজামাল (র.), শাহ মখদুম (র.), শাহ পরান (র.), খানজাহান আলী (র.)-এর ধর্মপ্রচার ও মসজিদ ঈদগাহ নির্মাণের সাথে শাসক শ্রেণির তেমন যোগ ছিল না। এছাড়া ব্রিটিশ আমলের পুরোটা জুড়েই ঈদ উৎসবে মুসলমানদের জন্য তেমন কোনও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। ১৮৯০ সালের পর থেকে ঢাকার নবাবদের জীবনযাত্রার ইতিহাসে ক্রমশ ঈদ আয়োজন, ঈদের জামাত, ঈদমেলা ও খাবার-দাবারের বিবরণ পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ আমলে ঈদের কিছু কিছু রেওয়াজ ঢাকার নবাবদের আয়োজনে দেখতে থাকেন ঢাকাবাসী। হাতি-ঘোড়া-উটের সমাহার, রংবেরঙের পতাকা, কাড়া-নাকাড়া তথা ব্যান্ড পার্টির বাজনাবাদ্যি, রাস্তার দুইধারের মানুষকে টাকা বিলানো এবং পায়েস-জর্দা ও ফিরনি খাওয়ানো ছিল আয়োজনের অংশ। ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে আলম মুসাওয়ার নামে এক শিল্পীর আঁকা এমন ৩৯টি ছবি আছে। এই হাতি-ঘোড়া আবার জন্মাষ্টমী কিংবা মহররমের মিছিলে দেখা যেতো, বেশিরভাগ সময় এদের ধার দিতেন নবাবরাই। খেলাধুলার আয়োজনও করতেন নবাবরা। তবে ঈদের আসল এবং জমকালো উৎসব হতো নবাবদের দিলকুশার বাগানবাড়িতে (বর্তমানের বঙ্গভবন)। মুঘল আমলের মতো রাজা, জমিদার, ইংরেজ অমাত্য, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বড় বড় নেতারা এই উৎসব বা পার্টিতে অংশ নিতে পারতেন। নবাবদের কল্যাণে প্রজারা থিয়েটার এবং নাটক দেখতে পারতেন, সিনেমা দেখারও সুযোগ পেতেন। সাধারণদের জন্য তখন ঈদ উৎসব ছিল দূর থেকে দেখার ব্যাপার, শাসকদের সাহায্য লাভের ব্যাপার। নবাবদের পরবর্তী প্রজন্ম এমন শান-শওকত ধরে রাখেতে পারেননি। আর ১৯৪৭ সালের পরে পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়।
আজকাল ঈদের আনন্দের সাথে বহু কিছু যোগ হয়েছে, যা আগে কল্পনাও করা যেতো না। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করার রেওয়াজ আগেও ছিল। কিন্তু এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উন্মাদনাও! তাই এই ঈদযাত্রার নাম হয়ে গেছে ঈদ ভোগান্তি। এখন ঈদ মানেই রাস্তা খারাপ। বৃষ্টির পানিতে রাস্তার যাই যাই অবস্থা। ঈদ এলে বাস আর ট্রেনের টিকিট হয়ে যায় সোনার হরিণ। সারা রাত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে, ঘোড়ার মতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পরদিন সকাল দশটায় যে বাস বা ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়, সেই বাস বা ট্রেন সময়মতো আসার রেওয়াজ নেই।
আগে কাগজ কেটে বা কাপড়ে সেলাই করে লেখা হতো ঈদ মোবারক। কেউ কেউ সেটা বাঁধাতেনও। টেলিভিশনের মতো একটা বাক্স তৈরি করে ভেতরে লাইট দিয়ে সারাদিন, সারারাত ঈদ মোবারক টেলিভিশনের মতো করে চালানো হতো। রঙিন কাগজ কেটে আর জরি ও বেলুন দিয়ে ঘর সাজানোর রেওয়াজ ছিল। শিশু-কিশোরদের হাতে থাকতো বাঁশি, নতুন খেলনা কিংবা লাটিম। খুব ছোট ছোট লঞ্চ, যেটি সামান্য তেলে আগুন জ্বালিয়ে পানিতে চালানো হতো কিংবা রংবেরঙের ইয়ো ইয়ো নিয়ে মেতে থাকতো ছোটরা। এখন থাকে নিত্যনতুন বিভিন্ন ব্রান্ডের ট্যাব কিংবা মোবাইল নিয়ে! এখন নতুন অ্যাপসের গুণাগুণ বর্ণনাই স্মার্টনেস। আগে নতুন কাপড় লুকিয়ে রাখতো ছেলেমেয়েরা যেন কেউ দেখতে না পারে। ঈদের দিন নামাজের পর নতুন জামা কাপড় পরতো সবাই। এখন মার্কেটে গেলে তার সেলফি ফেসবুকে দেওয়া হয়, যে পোশাক কেনা হয়, সেটার ছবিও অনেকে ফেসবুকে শেয়ার করে। ঈদের কোনও কিছুতে এখন আর লুকোচাপা নেই। ঈদের সঙ্গে যেন যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিকতা এবং প্রযুক্তির সর্বশেষ ধাপ। আগে ঈদের দিন লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা করার রেওয়াজ ছিল। এখন সেটাতে সাহসিকতা যুক্ত হয়েছে, যুক্ত হয়েছে রেস্তোরাঁ কালচার। আগে ঈদে নতুন বাংলা ছবি মুক্তি পেতো। একমাত্র চ্যানেল বিটিভিতে হাসির নাটক আর গান প্রচারের রেওয়াজ ছিল। ছিল আনন্দমেলা নামের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। এখন ত্রিশটির বেশি টেলিভিশন চ্যানেল! অসংখ্য নাটক, গান আর অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়, মানুষ কতগুলো দেখে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
তবু ঈদ ফিরে ফিরে আসে। ভবিষ্যতের ঈদ হয়তো আরও বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হবে। এখন বাস আর কেবল ট্রেনের ছাদে চড়ে বহু মানুষ যায় না প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করতে, যাদের টাকা আছে তারা বিমানেও যায় অন্য কোনও দেশে ঈদ কাটাতে। ভবিষ্যতে হয়তো যাবে মঙ্গল গ্রহে। যাদের বিদেশ বা মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার জন্য বেশি টাকা প্রয়োজন, তারা রমজানে সব পণ্যের দাম বাড়াবে, ৭০০ টাকার কাপড় বেচবে ১৩০০ টাকায়। যিনি এই অবিচারের শাস্তি দিতে যাবেন, তাকে বদলি করে দেওয়ার চেষ্টাও চলবে। যাদের টাকা নেই, যারা সামান্য কিছু টাকার জন্য ধান চাষ করে, তারাও ঈদের আগে ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে না, ধানে আগুন দিয়ে মিছেই অভিমান করবে। অনেকেই একটুকরো কাপড়ের জন্য বিক্রি করবেন হালের বলদ কিংবা পোষা মুরগি বা হাস! চাষিদের সন্তানরা স্কুল-কলেজেও যেতে পারবে না। কারণ, তারা আর একটা বছর বেঁচে থাকার টাকা ধান থেকে তুলতে পারেনি। তাই তাদের উৎসবের আনন্দ প্রায় সবক্ষেত্রেই পরিণত হয় বেদনায়।
এই ঈদের প্রার্থনা হোক ধানের ন্যায্য দাম!
লেখক: রম্যলেখক