পুকুর চুরি থেকে ‘বালিশ চুরি’

মো. জাকির হোসেনস্কুল-কলেজে পড়ার সময় বাংলা ব্যাকরণে ‘পুকুর চুরি’ বলে একটি বাগধারা পড়েছি। বড় ধরনের দুর্নীতি বোঝাতে পুকুর চুরি বাগধারাটির ব্যবহার করা হয়। শিক্ষক ক্লাসে এলাহি কাণ্ড ও পুকুর চুরি—এ দু’টি বাগধারা পড়ানোর পর এক ছাত্র জিজ্ঞেস করেছিল, এলাহি কাণ্ড মানে বিশাল ঘটনা। তাহলে পুকুর চুরি না বলে এলাহি চুরি বললে অসুবিধা কী? ‘পুকুর চুরি’ বাগধারার পক্ষে শিক্ষক অনেক গল্প শোনান। এক সরকারি কর্মকর্তা অর্থ আত্মসাতের পরিকল্পনা করেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে পত্র লেখেন তার এখতিয়ারাধীন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জল সরবরাহের সুবিধার্থে একটি বড় পুকুর খনন জরুরি। পত্রের বক্তব্য অনুমোদন করে পুকুর খননের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে কর্মকর্তা পুকুর খননবাবদ ব্যয়ের হিসাব দেখিয়ে বিবরণী তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দফতরে দাখিল করেন। এর কয়েক মাস পর ওই কর্মকর্তা সরকারকে আবারও পত্র লেখেন পুকুর খনন করায় পুকুরের পানিতে ডুবে প্রায়শই মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ অঞ্চলের মানুষের চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন হচ্ছে বিধায় পুকুর ভরাট করা জরুরি হয়ে পড়েছে। পুকুর ভরাটের আবেদন মঞ্জুর করে সরকারের তরফ থেকে এবার পুকুর ভরাটের জন্য আর্থিক মঞ্জুরি দেওয়া হয়। কর্মকর্তা পুকুর ভরাটের ব্যয় বিবরণীও যথারীতি দাখিল করেন। সরকারি নথিতে পুকুর খনন ও পুকুর ভরাটের জন্য আর্থিক বরাদ্দ ও ব্যয়ের বিষয় উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে পুকুর খনন ও ভরাট কোনোটিই হয়নি। শিক্ষক বললেন, এটাই হলো পুকুর চুরি।

পুকুর চুরিতে সরকারি কর্মকর্তা পুকুর খনন ও ভরাটের অর্থ আত্মসাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছেন। তিনি পুকুর পাড়ে গাছ লাগানো ও সে গাছ কাটা বাবদ খরচের খাত সৃষ্টির মতো সৃজনশীলতা দেখাতে পারেননি। কিন্তু বালিশ চুরিতে বালিশের আকাশচুম্বী দামের পাশাপাশি ‘ওঠানো খাত’ থেকে বিশাল চুরির যে সৃজনশীলতা দেখানো হয়েছে, তা পুকুর চুরিকেও হার মানায়। আলোচিত সেই বালিশের একটির দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। ওই একটি করে বালিশ ভবনের জন্য ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। আবাসিক ভবনের জন্য প্রতিটি কেটলি কেনা হয়েছে ৭ হাজার ৭৫৭ টাকায়। সেই কেটলি ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। রুম পরিষ্কারের মেশিন একেকটা কেনা হয়েছে ১২ হাজার ১৮ টাকায়। ভবনে তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা। প্রতিটি ইলেকট্রিক আয়রন কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ১৫৪ টাকা। ভবনে একটি আয়রন তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। একেকটি টেলিভিশন কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকায়। ওই একটি করে টেলিভিশন ভবনে ওঠানোর জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ৭ হাজার ৬৩৮ টাকা। একটি করে ফ্রিজ কেনা হয়েছে ৯৪ হাজার ২৫০ টাকায়। ভবনে প্রতিটি ফ্রিজ ওঠানোর খরচ দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা। একটি করে ওয়্যারড্রোবের দাম ধরা হয়েছে ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা। ভবনে প্রতিটি ওয়্যারড্রোব ওঠানোর জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ১৭ হাজার ৪৯৯ টাকা। একটি করে বিছানার চাদরের দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা আর প্রতিটি চাদর ভবনে ওঠানোর জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা। মালপত্র ভবনে ওঠানোর খাতে ‘এলাহি চুরির’ সৃষ্টিশীলতা দুর্নীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে এবং নতুন ব্যবসার সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে। ওভাই বা পাঠাওডটকম-এর মতো হয়তো ওঠাওডটকম সার্ভিস অচিরেই চালু হবে।

উল্লেখ্য, প্রতিটি বালিশের যে দাম দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, এটি প্রকৃত মূল্য নয়। অধিকাংশ সরকারি প্রকৌশল অফিসের ঠিকাদারকে তার সম্পাদিত কাজের জন্য প্রাপ্য বিলের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ (৫-১৫%) বাধ্যতামূলকভাবে অফিসকে দিতে হয় যা ‘পার্সেনটেজ’ নামে পরিচিত। বালিশের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে হলে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকার সঙ্গে পার্সেনটেজ বাবদ প্রদত্ত অর্থের অংশও যোগ করতে হবে। বালিশ, গৃহস্থালী আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিকস ক্রয় ও ওঠানো খাতে চুরি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে কয়েক’শ গুণ বেশি অর্থ ব্যয়ে যে অনেক বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে, সেখানে কী ঘটেছে, তা আলোচনার বাইরে রয়ে গিয়েছে।

প্রিয় পাঠক, বিশ্বে সবচেয়ে দামি বালিশ তৈরি করে VAN DER HILST নামক নেদারল্যান্ডসের একটি কোম্পানি। এই কোম্পানির একটি সাধারণ বালিশের দাম ৪ হাজার ৯৯৫ ডলার যা বাংলাদেশি টাকায় ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এই কোম্পানি সম্প্রতি তাদের বানানো বালিশের গোল্ড অ্যাডিশন বাজারে এনেছে, যার বাজার মূল্য ৫৬ হাজার ৯৯৫ ডলার। বাংলাদেশি টাকায় মূল্য ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

সোশ্যাল মিডিয়া এই বালিশ নিয়ে নানান ঘটনা নিয়ে আলোচনা এসেছে—তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সরকারি পর্যায়ে প্রথম দামি বালিশ ক্রয় করা হয় ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের জন্য। প্রতিটি ১৫ হাজার টাকা দরে ভারতের জয়পুর থেকে ১২টি বালিশ অনা হয় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। ১৯৯১ সালেও খালেদা জিয়ার জন্য নাকি প্রতিটি ৭৮ হাজার টাকা মূল্যে ৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় ৬টি বালিশ কেনা হয় প্যারিস থেকে। প্যারিস থেকে এ বালিশ আনতে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এরপর ২০০২ সনে খালেদা জিয়ার জন্য ইটালি থেকে ৬টি কুশন পিলো কেনা হয় যার প্রতিটির মূল্য ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার।

ফেসবুকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বালিশের দাম নিয়ে ট্রল দেখে প্রথমে আমার ধারণা হয়েছিল পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য তেজষ্ক্রিয়রোধী কোনও বিশেষ বালিশ হওয়ায় দাম বেশি। কিংবা এ ধরনের বালিশে বিশেষ কোনও মালিশ রয়েছে যা পারমাণবিক প্রকল্প এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য প্রযোজ্য। পরে সত্য ঘটনা জেনে আহত হলেও অবাক হইনি। বাংলাদেশে যে কয়টি সেক্টরে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠিানিক রূপধারণ করেছে ও বাংলাদেশের মানুষ তা মেনে নিয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো প্রকৌশল অফিস। অধিকাংশ সরকারি প্রকৌশল অফিসের ঠিকাদারকে তার সম্পাদিত কাজের জন্য প্রাপ্য বিলের ওপর বাধ্যতামূলক যে ‘পার্সেনটেজ’ দিতে হয়, তা বণ্টনের একটি প্রতিষ্ঠিানিক নিয়মও গড়ে উঠেছে কে কত পার্সেন্ট পাবে। পার্সেনটেজ নামে পরিচিত ঘুষ এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে যে, যিনি দিচ্ছেন ও নিচ্ছেন, তাদের কেউই একে আইনের লঙ্ঘন বা ধর্ম ও নৈতিকতায় নিষিদ্ধ বলে মনে করছেন না। আমি সফেদ দাঁড়িওয়ালা, পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত একজন ঠিকাদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম হাদিসে আছে ‘ঘুষদাতা ও ঘুষখোর উভয়েই দোজখের আগুনে জ্বলবে’, কিন্তু আপনি তো পার্সেনটেজ দিচ্ছেন। এর কী হবে? তিনি উত্তর দিয়েছেন, এটা তো অফিসের নিয়ম।

আরেকটি ঘটনা বলি। আমার পরিচিত একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী যিনি ঠিকাদারের কাছ থেকে পার্সেনটেজের চেয়েও অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে এলাকায় কুখ্যাত। পার্সেন্টেজের টাকায় বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি। প্রকৌশলী সাহেব হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এলাকাবাসীর মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এলো, যা হোক লোকটার সুমতি হয়েছে। অবাক করা কাণ্ড হলো, হজ থেকে ফিরে অফিসে যোগ দিয়েই তার অনুপস্থিতিতে অফিসে যে পার্সেন্টেজ আদায় হয়েছে, তার অংশ তিনি দাবি করে বসলেন। এলাকার লোকজন এ নিয়ে দু-চার দিন আলোচনা-সমালোচনা করলো তার পর সব আগের মতো হয়ে গেলো।

রূপপুর বালিশকাণ্ডের খবর প্রকাশের পর সরকার বেশ তৎপর হয়েছে। প্রকল্পে আসবাবপত্রসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্য কেনার দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সব বিল আটকে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। মানসম্মতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্বচ্ছ ও দক্ষ ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। গত পাঁচ বছরে মানহীনভাবে বাস্তবায়িত প্রকল্পের ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যেসব ঠিকাদার দুর্নীতিবাজ ও অদক্ষ তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এর অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে (২০১৪-২০১৮) যেসব উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলোর ঠিকাদারদের বিস্তারিত তথ্য নিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

সম্প্রতি সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় চিঠি দিয়ে গত পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন হয়েছে—এমন সব প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। উদ্যোগ কেবল ঠিকাদারদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রকৌশল অফিস ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়েও বিশেষ গুরুত্বসহকারে চিন্তা করার সময় এসেছে। গত ৯ বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশা কাটেনি। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট-২০১৯’ প্রতিবেদনে বলা হয়, সড়ক অবকাঠামোর মানের ভিত্তিতে প্রণীত সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল ছাড়া অন্য সব দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৩৫ দশমিক ২, আর নেপালের ২৭। শ্রীলঙ্কার স্কোর ৪৬ দশমিক ৭, ভারতের ৫৭ দশমিক ৪ এবং পাকিস্তানের ৪৯ দশমিক ১। সামগ্রিকভাবে অবকাঠামো বিবেচনায় ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক ব্যবস্থা সবচেয়ে খারাপ যেসব দেশের তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের প্রতিবেদনেও সড়কব্যবস্থার যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা সুখকর নয়। সরকারের হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স (এইচডিএম) হিসাব বলছে, সারা দেশে ‘দুর্বল’ সড়কের দৈর্ঘ্য ২ হাজার ৫২৮ কিলোমিটার; ‘খারাপ’ তালিকাভুক্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ২৮২ কিলোমিটার, আর ‘খুব খারাপ’ সড়ক রয়েছে ১ হাজার ৮৪৩ কিলোমিটার। বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা এত খারাপ হলেও এইসব সড়কের নির্মাণে কিন্তু কম টাকা খরচ করা হয়নি! বরং বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বিগত বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক নির্মাণে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে বাংলাদেশে।

গত বছরের জুন মাসে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে প্রতিবেশি ভারত ও চীনের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে বাংলাদেশ। এই বাড়তি খরচের জন্য উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়া ও দরপত্রে প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছিল বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, চার লেন সড়ক নির্মাণে রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কে সড়কের প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৬৬ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ ডলার, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে এক কোটি ১৯ লাখ ডলার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার খরচ নির্ধারিত হয়েছে। অন্যদিকে চার লেন সড়ক তৈরিতে ভারতে ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার ও চীনে ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার খরচ হয়। এই হিসাব অনুযায়ী ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার খরচ ভারতের কিছু সড়কের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।

এছাড়া, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেনেভায় ইউএন-ইসিই (ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ) আয়োজিত এক সেমিনারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মহাসড়ক নির্মাণের তুলনামূলক ব্যয়ের চিত্র তুলে ধরেন গ্রিসের ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব এথেন্সের অধ্যাপক দিমিত্রিয়স স্যামবুলাস। ‘এস্টিমেটিং অ্যান্ড বেঞ্চমার্কিং ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার কস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি জানান, চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খরচ হয় গড়ে ৩৫ লাখ ডলার বা ২৮ কোটি টাকা। আর দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত করতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২৫ লাখ ডলার বা ২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চার লেনের সড়কের চেয়ে ইউরোপে চার লেনের সড়ক নির্মাণের খরচ অর্ধেক। সড়ক নির্মাণে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় মেনে নেওয়া যেতো যদি তা টেকসই হতো। কতটা খারাপ কাজ হচ্ছে তা দুই-একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। কিছু কিছু রাস্তায় হাত দিয়ে বিটুমিনের স্তর তুলে ফেলা যাচ্ছে। ভবন, ব্রিজ নির্মাণে রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু ব্রিজে সিমেন্টের পরিবর্তে মাটি ব্যবহার করা হয়েছে। রাস্তার এক প্রান্ত নির্মাণ করে অন্য প্রান্ত শেষ করার আগেই খানা-খন্দে ভরা রাস্তা পুকুর-ডোবায় পরিণত হচ্ছে। ফ্লাইওভারে বৃষ্টির পানি জমে হাঁটুজল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটিশ শাসকরা কংক্রিট দিয়ে বাংলাদেশে যে রাস্তা নির্মাণ করেছিল কয়েক দশক পরও খানা-খন্দ দূরে থাক আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে তা ভাঙা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার কংক্রিট দিয়ে রাস্তা নির্মাণের আহ্বান জানালেও এটি খুব একটা আমলে নেওয়া হয়েছে বলে পরিলিক্ষিত হচ্ছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগ, সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), এলজিইডি, পিডব্লিউডি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সব প্রতিষ্ঠানের রেট শিডিউল নিয়েও আলোচনার সময় এসেছে। মানসম্মতভাবে কোনও ভবন, ব্রিজ, রাস্তা ইত্যাদি নির্মাণ করতে প্রকৃত যা ব্যয় হয় তার থেকে ৪০-৪৫ শতাংশ বেশি মূল্য নির্ধারণ করা আছে এ শিডিউলে। দুর্নীতির  মচ্ছবের সুযোগ শিডিউলের রেটেই রয়েছে।  

প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের পুকুর চুরি ও সম্পদ বিদেশে পাচার বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রকৌশলী মাসুদ আলম যিনি ইতোমধ্যে ‘বালিশ মাসুদ’ খ্যতি পেয়েছেন, তার বালিশকাণ্ডের পর পুকুর চুরি ম্লান হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে পুকুর চুরি বাগধারা ‘বালিশ চুরিতে’ রূপান্তরিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: zhossain1965@gmail.com

 

/এমএনএইচ/