বাংলাদেশে রোগীবান্ধব চিকিৎসকের ঘাটতি নেই। সরকারি-বেসরকারি বড় হাসপাতাল থেকে শুরু করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তারা কাজ করছেন। সেবা পাচ্ছেন রোগীরা। উল্টোচিত্রও আছে। চিকিৎসকদের উল্লেখ করার মতো একটি অংশ জড়িয়ে পড়েছেন স্বাস্থ্য বাণিজ্যে। তারা ব্যবস্থাপত্র ভরাট করেন অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে। নগদ কমিশন থেকে শুরু করে প্লট, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশযাত্রা এবং কমিশন হিসেবে ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে বান্ধবীও পেয়ে থাকেন। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, অপারেশন এবং হাসপাতালের সিট ভরিয়ে রাখার কমিশন তো আছেই। সঙ্গে আছে তাদের অমানবিক ব্যবহার। প্যাথলজিক্যাল ল্যাব সেটি যতই তারকাখচিত হোক না কেন, তাদের রিপোর্টে আস্থা রাখা মুশকিল। দুই-তিন ল্যাবের রিপোর্টে পাওয়া যায় রকমারি ফলাফল। ফলে সামান্য রোগও কখনও কখনও রোগীর কাছে দুরারোগ্য ব্যাধির আতঙ্ক নিয়ে দেখা দেয়। ভুল চিকিৎসায় কোনও কোনও রোগী বা তার পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর জানতে পারেন, আসলে রোগটি ছিল মামুলি কিছু। বিপরীত চিত্রও আছে। চিকিৎসকরা যাকে মামুলি বলে পাত্তা দিলন না, আসলে সেটা ছিল জটিল কোনও রোগ। সঙ্গে আছে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ, ডায়ালায়সিস, কেমোথেরাপি এবং শয্যা বাণিজ্য। রোগীকে অযথাই আইসিউতে ঠেলে দিয়ে পরিজনদের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া। প্রয়োজন নেই, তারপরও হাসপাতালে ভর্তি করা। বিশেষ করে প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক প্রসব করানোর বিদ্যাটা যেন ভুলেই বসে আছেন আমাদের চিকিৎসকরা। সরকারি হাসপাতালের রোগও কম নয়। সেখানে টাকা ও পরিচিত নার্স, কর্মচারী, চিকিৎসক না থাকলে প্রয়োজনীয় সেবা পাওয়া যায় না। আছে শয্যা সংকট। চিকিৎসক ঘাটতি। রাজধানীর বাইরের সরকারি হাসপাতালগুলো নিজেরাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত।
রোগী ও তাদের স্বজনদের এই অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবা সম্পর্কে আস্থাহীনতার ধারণা তৈরি করে দিয়েছে। ফলে জমি বেচে দিয়ে হলেও মানুষ একবার সীমানা পেরোতে চায়। সেখানে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন, ভুল চিকিৎসায় সারা জীবন ভুগেছেন—এমন রোগীও আছেন বিস্তর। কিন্তু সেই করুণ কাহিনির চেয়ে লোকমুখে ঘুরে বেড়ায়, বিদেশের চিকিৎসা নেওয়ার নানা মিথ। দেশের বাইরের কোনও কোনও চিকিৎসক নিয়ে ভুল মিথও বিরাজমান। অথচ তাদের চেয়ে যোগ্য নিবেদিত অসংখ্য চিকিৎসক বাংলাদেশের নিজেরই আছে। চিকিৎসক, হাসপাতাল এবং সরকারি স্বাস্থ্যসেবার দফতরগুলোর লোভের পাপেই বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। চিকিৎসকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, জাতীয় রাজনীতিকে পেশার চেয়ে এগিয়ে রাখার কারণে এই দুরারোগ্য কোনও ওষুধেই নিরাময় করা যাচ্ছে না। বরং দিনকে দিন তা আরও জটিল আকার ধারণ করছে। সীমান্তের ওপারের এবং নিকট প্রাচ্যের দেশগুলো স্বাস্থ্যখাতের অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে সেবকের মুখোশ পরে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুমূর্ষু বিচলিত রোগী ও স্বজনরা নিরুপায় হয়ে সেই মুখোশের হাতটি ধরতেই বাধ্য হচ্ছেন।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি