পরম্পরায় আমরা নগরপিতাদের কাছ থেকে একই বচনের সঙ্গে কিছু বোনাসও পাচ্ছি। রাজধানীকে দুই ভাগে বিভক্ত করায় এক অংশের নগরপিতা বলছেন, তার এলাকায় মশা নেই, মশা পাশের এলাকা থেকে চলে আসছে। কখনও তারা বলছেন ওষুধে মশাকে ঘায়েল করা যাচ্ছে না। ওষুধের কার্যকরী ক্ষমতা গেছে। মশা শক্তিশালী হয়েছে। আবার উচ্চ আদালতের চোখ রাঙানিতে বচন পাল্টে বলছেন, ‘মশার ওষুধের শক্তি আগের মতোই আছে। ওষুধ দিলে তারা অজ্ঞান হয়ে যায়, কিছু সময় পর আবার জ্ঞান ফিরে পেয়ে শুরু করে হামলা।’ একজন মেয়র বলছেন, ‘ছেলেধরা’ গুজবের মতোই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ানোও একটা গুজব। তাদের সুরে সুর মিলিয়ে অন্য দফতরের মন্ত্রী বলেন, ‘মশাদের প্রজনন ঘটছে রোহিঙ্গাদের মতো।’ রাজধানীসহ সারাদেশের হাসপাতাল যখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীতে ভরপুর, তখন এসব ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানের চুটকি নগরবাসীর যন্ত্রণার তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেয়। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে নগরবাসী নিজেদের আবিষ্কার করে এক তামাশার শহরে। তামাশারই সেই দুই দশক আগের ফ্যাশনে দুই মেয়র প্রতিদিনই নতুন গেঞ্জি টুপি পরে ডেঙ্গু সচেতনতার র্যালিতে নামছেন। ছোট-বড় পর্দার তারকাদের নিয়ে হেসে খেলে হাঁটছেন। এই তারকাদের দেখে মশার যেমন ‘ডর’ লাগছে না, তেমনি নগরের মানুষেরাও তাদের দেখে সচেতন হওয়ার তাগিদবোধ করেন না। কারণ আজকাল মুক্ত আকাশ বাতাসের যুগে ওই তারকাদের সচেতনতার আমলনামাও নগরবাসীর হাতে।
তারকাদের টিভি ক্যামেরা সহযোগে মাঠে নামার দরকার ছিল না। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা সিটি করপোরেশনের কর্মী, স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে যদি নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামতেন, তাহলে এডিস মশার লার্ভা জন্ম দেওয়ার বেশিরভাগ উৎসই নষ্ট করা যেতো। ঘরে ঘরে সচেতনতার আনুপাতিক হার বেড়ে যেতো। সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেওয়াও সহজ হতো।
রাজধানীতে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে একটি দফতর ধুঁকে ধুঁকে চলছে। মশক নিবারণী দফতর দোতলা হওয়ার আগে অসংখ্যবার যাওয়া হয়েছে। ঢাকেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন এই দফতরটিকে কখনও সক্রিয় করা হয়নি। সিটি করপোরেশনের একপ্রকার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কীটতত্ত্ব বিভাগের মতো মশা ও মশার ওষুধের কার্যক্ষমতা প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা কাজে ব্যবহার করা যেতো এই দফতরকে। দেড় কোটি মানুষের বসবাস যে শহরে, এবং এখানকার নাগরিকদের দশকের পর দশক যে কীটের যন্ত্রণা ভোগ করতে হচ্ছে, তাকে নির্মূল, দমন, নিয়ন্ত্রণের জন্য এই দফতরটি কার্যকরের কথা কি নগরপিতারা ভাববেন না? নাকি এই দফতর কেন মশা নির্মূলে সক্রিয় করা হয়নি বা হচ্ছে না, এমন রুল আসতে হবে মাননীয় উচ্চ আদালত থেকে?
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি