মেয়র সাহেব, একবার আসুন

সারওয়ার-উল-ইসলামঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আসবেন, তাই ঝটপট রাস্তার দুই পাশের ফুটপাত খালি। শুধু কি ফুটপাত? ফুটপাত ডিঙিয়ে রাস্তার ওপরে যেখানে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো হয়, সেগুলোও তড়িঘড়ি করে খুলে ফেলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকে দোকানিরা। এ যেন লুকোচুরি খেলা।
পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট ছেলেরা কারো কারো বাড়ির সামনেই একটু জায়গা পেলে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলে। কী করবে? ওদের তো আর খেলার মাঠ নেই। তাই দুধের সাধ ঘোলে মেটানো আর কী! কিন্তু যখনই ওই বাড়ির কোনও মুরব্বি বাসা থেকে বের হন, যিনি হয়তো বাসার সামনে হইচই করে খেলার কারণে বকাঝকা দিতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা খেলা বাদ দিয়ে দৌড়ে এদিক-সেদিক লুকিয়ে থাকে। যাতে ওই মুরব্বি দেখতে না পায়। আবার যখন মুরব্বি অনেক দূরে চলে যান, সঙ্গে সঙ্গে আবার খেলা শুরু হয়ে যায়।
দুটি দৃশ্যই প্রায় একইরকম। একটি হচ্ছে খেলার মাঠ নেই বলে বাসার সামনে খেলা। আরেকটি হচ্ছে মানুষ তার জীবিকা নির্বাহ করার জন্য ফুটপাতে ক্ষুদ্র ব্যবসা নিয়ে বসে। কারণ তাদের সামর্থ্য নেই বড় কোনও মার্কেট বা শপিং মলে কোটি টাকা বা লাখ লাখ টাকা দিয়ে দোকান বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করার। তাই প্রতিদিন স্থানীয় প্রভাবশালীদের লোকজনকে ১০০-১৫০ টাকা দিয়ে ফুটপাতে ব্যবসা নিয়ে বসে, বিক্রি-বাট্টা করে পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চালিয়ে যায়।

বিষয়টা মানবিক দিক দিয়ে দেখলে মনে হবে ঠিকই আছে। আবার অন্যদিক দিয়ে দেখলে কী মনে হবে? মনে হবে না, সরকারি জায়গায় দোকান বসার সুযোগ করে দিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় একশ্রেণির মানুষ কামিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা? যার ভাগ পাচ্ছে এলাকার পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিসহ সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। কোন ক্ষমতাবলে মানুষকে তার নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত করে, ফুটপাত দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলার ব্যাঘাত ঘটিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা?

ঢাকার প্রায় বেশিরভাগ ফুটপাতই দখলে চলে গেছে এলাকার নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে। কে দেখবে? সবার পকেটেই তো চলে যায় মাস শেষে লাখ লাখ টাকা।

মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর। পশ্চিমে চলে গেছে মিরপুর দুই নম্বর হয়ে ১ নম্বরের দিকে। আর পূর্ব দিকে চলে গেছে মিরপুর গার্লস আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ হয়ে মিরপুর ১৪ নম্বরের দিকে। এই দুই দিকেই চলে লুকোচুরি খেলা। বুঝতে বাকি থাকে না মেয়র আসতে পারে, কারণ সুনসান নীরবতা। হকারের চিৎকার চেঁচামেচি নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে ঠিকমতো পথচারীরা যেতে পারছেন মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরের দিকে। আবার মেয়র চলে যেতেই আগের অবস্থা।

বিষয়টা এরকম, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশেই হকাররা যার যার ব্যবসা গুঁটিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকানপাটের লাঠিবাঁশ-ত্রিপল খুলে নিয়ে যায়, কখনও পাশেই রেখে দেয়। আবার মেয়র চলে যেতেই দোকান বসিয়ে ব্যবসা শুরু করে।

মিরপুর ১০ নম্বর থেকে পূর্ব দিকে রাস্তার দু’পাশের ফুটপাত দখল করে ব্যবসা চলে পানির ট্যাংক হয়ে হোপ স্কুল পর্যন্ত। মিরপুরবাসীর সবচেয়ে জনপ্রিয় কেনাকাটার জায়গায় পরিণত হয়েছে এটি। পানির ট্যাংকের সামনে প্রধান সড়ক থেকে হাতের বাঁয়ে বিশাল ৬০ ফিট রাস্তাটি যেন সরকার তৈরি করে দিয়েছে ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করার জন্যই। আপাতদৃষ্টিতে এমনটাই মনে হতে পারে। কারণ শুধু ফুটপাত নয়, ফুটপাত পার হয়ে মূল রাস্তার অর্ধেকটাই দু’পাশ থেকে দখল হয়ে গেছে ব্যবসার জন্য। পিচঢালা রাস্তার ওপর কাঠবাঁশ গেড়ে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। গাড়ি চলার ব্যাঘাত ঘটিয়ে শোনা যায় প্রতিমাসে তিরিশ লাখ টাকা ওঠানো হয় এসব দোকানপাট থেকে। কে দেখবে?

প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের স্বপ্ন ছিল তার এলাকার ফুটপাত দখলমুক্ত রাখবেন। তিনি চেষ্টাও চালিয়েছেন। তার মৃত্যুর পর পরবর্তী সময়ে নতুন মেয়র আতিকুল ইসলাম একই কথা বলেছেন। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, মেয়র আতিকুল ইসলাম কোনোভাবেই দখলমুক্ত করার ব্যাপারে কঠোর হতে পারছেন না। তার ইচ্ছা আছে, কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কেন যেন তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছেন। আর সেজন্যই যেদিন তিনি আসবেন ফুটপাত খালি, চলে যেতেই হকারদের আনন্দের তালি দেখা যায়।

তিনি কি কোনোদিন আচমকা চলে আসতে পারেন না? কাউকে কিছু না বলে চলে এসে দেখবেন মিরপুর ১০ নম্বরের আশপাশের ফুটপাতগুলো কাদের দখলে। যারা তাকে নির্বাচিত করেছেন তারা কি ঠিকভাবে ফুটপাতে হাঁটতে পারছেন, নাকি তিনি মনে করছেন নির্বাচিত হতে তো কোনও বেগ পেতে হয়নি, কেন ভোটারদের কষ্ট দেখভাল করবো?

মাননীয় উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র, আপনি যেভাবেই নির্বাচিত হয়ে থাকুন না কেন, একবার একটু আওয়াজ না দিয়ে এই এলাকায় চুপে চুপে এসে বিকালবেলা দেখে যান, কেমন কানার হাটবাজার বসিয়ে ব্যবসা চালানো হয়। কত লাখ টাকা তোলা হয় প্রতিদিন, সেই হিসাব কেউ আপনাকে দেবে না। আপনার বিশ্বস্ত লোকজন দিয়ে একটু যাচাই করে দেখুন, টাকার অঙ্কটা কত বড়। সেই টাকার ভাগ কাদের পকেটে যাচ্ছে, সহজেই জানতে পারবেন।

দেশের ক্ষতি কি শুধু একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল করছে নাকি সরকারের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা লোকজন করছে, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করে সরকারের যেমন ১২টা বাজাচ্ছে একটি চক্র, তেমনি রাস্তাঘাট দখল করে, ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বসিয়ে ব্যবসা করে জনগণকে বিষিয়ে তুলছে সরকারের ভেতরে থাকা লোকজন। ফুটপাতে হাঁটতে না পেরে মনে মনে গাল দিচ্ছে সরকারকে। গাল দিচ্ছে আপনাকেও।

আজকাল কোথাও কিছু হলে নির্যাতিত ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা নগরপ্রধানদের যোগ্য মনে করছেন না বা তাদের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। তাহলে তো দেশ ক্রমশ অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হতে থাকবে। মানুষ দোষারোপ করবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তার সরকার ব্যর্থ, এটাই পক্ষান্তরে বলে বেড়াবে।

সবকিছু যদি দেশের প্রধানকে দেখতে হয়, তাহলে আপনাদের থাকা না থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি একবার আওয়াজ ছাড়া আসুন। গরিব মানুষ অবশ্যই ব্যবসা করে সংসার নিয়ে ভালো থাকবে, এটা এ সরকার চায়। কিন্তু তার মানে এই নয়, রাস্তাঘাট দখল করে জনরোষ তৈরি করে ব্যক্তিবিশেষকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে সুযোগ করে দিতে হবে।

মাননীয় মেয়র বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন আশা করি। এভাবে শুধু মিরপুর নয়, আপনার প্রত্যেকটি নির্বাচনি এলাকার প্রায়ই এরকম চিত্র দেখতে পাবেন। বর্তমান সরকার আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার নির্বাচনি এলাকার উন্নতি যেন সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করতে পারে। আর এভাবেই সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার পবিত্র দায়িত্ব পালন করা হবে।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক