উন্নয়ন নামক ধারণাটির অন্তর্নিহিত জটিলতাকে স্বীকার না করলে রাজনীতির বিশ্লেষণ গভীরে যেতে পারে না। ভালো কাজ মানে কী? জিডিপি বা জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার কি সেই ভালো কাজের সার্থক মাপকাঠি? এমনকি দারিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষের অনুপাত কত শতাংশ কমলো, সেটাও কি মাপকাঠি হিসেবে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য? দুটিই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু এগুলো সামগ্রিক হিসাব।
ভারতের দুটি রাজ্য গুজরাট ও মহারাষ্ট্র সামগ্রিক হিসাবে যথেষ্ট উন্নত রাজ্য। কিন্তু সেখানে গত দুই বছর ১৬ হাজার কৃষক দুঃখ কষ্ট করে সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। আত্মহননও সত্য, সামগ্রিক হিসাবও সত্য। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে কোনও দরিদ্র দেশ থাকবে না। এমনকি সোমালিয়াও না। তাই বলে কি একশ্রেণির লোক, যারা অনাহারে ক্লিষ্ট হচ্ছে, বিনা চিকিৎসায় ক্লিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে তারাও আর অবশিষ্ট থাকবে না? রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে তারাও থাকবে, উন্নত রাষ্ট্র বলেও পরিচিতি পাবে।
আমাদের দেশে দুর্নীতির হাল-হকিকত কী? দুর্নীতি এখানে ব্যাপকভাবে গতিশীল। গত সপ্তাহে সিলেট কারা কর্তৃপক্ষের ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের ফ্ল্যাট থেকে ঘুষ-দুর্নীতির ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার স্ত্রী ঘরে রক্ষিত এক বস্তা টাকা দুদকের অভিযানের খবর পেয়ে পাশের বাসার ছাদে ফেলে দিয়েছে। তার দৈনিক অবৈধ আয় ছিল নাকি ১৬ লক্ষ টাকা। অফিসার বাবু তো কম টাকা রোজগার করেনি। আর টাকা গেল কোথায়?
ডিআইজি মিজানুর রহমান ৪০ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছে দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে। মিজানের সহায় সম্পদের হিসাব-নিকাশ করে বৈধ বলার জন্য। সে সুযোগ মিজানের রয়েছে, কারণ মিজান বিদেশি মিশনে ছিল। এখন নাকি চাকরিওয়ালারা বিদেশি মিশনে থাকলে সহজে টাকা সম্পদ বৈধ করা যায়। আর ব্যবসায়ীরা নাকি মাছের ঘেরের ব্যবস্থা থাকলে সহজে যেকোনও পরিমাণ অর্থ বৈধ করার পথ খোলা থাকে। ধন্যবাদ দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে। কারণ, পরিচালকের কথায় তিনি একমত হননি। মিজান তার টাকা ফেরত চেয়েছে দুদক পরিচালকের কাছে। এই নিয়ে পরিচালক আর মিজানের মতবিরোধ লেগেই সব তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে। এখন উভয়ে জেলে আছেন।
আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধি কথাটা খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। আমার মনে হয় আমাদের ঘুষের প্রবৃদ্ধিটাও সবচেয়ে উচ্চ হবে।
ঘুষটা এত ব্যাপক হয়ে গেলো কেন? আমি আমার আরেক লেখায় বলেছিলাম ঘুষের বয়স আর সভ্যতার বয়স প্রায় সমান। প্রাচীন প্রথা কখনও গতি পায় আবার কখনও স্লথ হয়। কখনও নির্মূল হয় না। তবে উপরে শক্ত কর্তা না থাকলে নিচে বাণিজ্যটা জমে ওঠে ভালো। এখন কিন্তু ঘুষ বাণিজ্যটা ব্যাপক রূপ নিয়েছে। উপরে নিচে সব একাকার হয়ে গেছে। মানুষ না খেয়ে নেই। উন্নয়ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা আওলাদে আছি। তবে এ প্রবৃদ্ধিটা কিছুটা প্রতিবন্ধী, কারণ এই প্রবৃদ্ধি এম্প্লয়মেন্ট সৃষ্টি করতে পারেনি। ভারতেও একই অবস্থা।
দুদক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুদিন আগে কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুদক নড়েচড়ে বসেছে। ওয়াসার দুর্নীতি অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা ১১ খাতে দুর্নীতির উৎস খুঁজে পেয়েছে। তারা তাদের সুপারিশ মন্ত্রণালয় পেশ করেছে। মন্ত্রণালয়ের এখনও ঘুম ভাঙেনি। অবশ্য মন্ত্রণালয়গুলোতে অসংখ্য অনভিজ্ঞ মন্ত্রী। অভিজ্ঞতাকে অবজ্ঞা করা কখনোই উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী এখন অসুস্থ হয়ে লন্ডনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দেশের ভয়াবহ অবস্থা। বন্যাদুর্গতদের কাছে এখনও পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। প্রধানমন্ত্রী এত সংবেদনশীল যে তার শরীর পারমিট করলে তিনি কখনও এ অবস্থায় দেশের বাইরে থাকতেন না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবো, তিনি এবার-সহ চারবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং তার চারটা মন্ত্রিসভা ছিল। এই চার মন্ত্রিসভার যারা সৎ ছিলেন এবং অভিজ্ঞতা আছে, উদ্যমী, তাদের নিয়ে যেন মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
এখন ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রীর বয়সের কারণে কর্মতৎপরতা কমে আসতে বাধ্য। সুতরাং তার এখন ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত, যেন দেশের মানুষ মন্ত্রীদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে কোনও বিষয়ে ভোগান্তিতে না পড়েন। ডেঙ্গু, বন্যা উপদ্রুত মানুষ আর দুর্নীতি সম্পর্কে খুবই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাই শক্তিশালী মন্ত্রিসভা প্রয়োজন। এখন হাইকোর্টও মাঝে মাঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেক কাজে হস্তক্ষেপ করছেন। সুস্পষ্টভাবে সবকিছু চললে তো হাইকোর্ট মাথা দিতো না, এই ভাষ্য হাইকোর্টের।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
bakhtiaruddinchowdhury@gmail.com