মূলধারার গণমাধ্যমের বর্ধিত দায়িত্ব

মো. সামসুল ইসলামদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে হঠাৎ করেই একইসঙ্গে বেশ কয়েকটি জটিল ইস্যুতে জনগণকে সার্বক্ষণিকভাবে অবহিত করার এক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। একদিকে দেশব্যাপী ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা, অপরদিকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, সেই সঙ্গে ছেলেধরার গুজব, শিশুদের খাদ্য দুধ নিয়ে বিতর্ক, এতগুলো বিষয়ে পুরো দেশবাসীকে জানানো ও আশ্বস্ত করার গুরুভার দেশীয় গণমাধ্যমকে বহন করতে হচ্ছে।
মিডিয়ার একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি বলবো আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম—পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন এবং সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বাসযোগ্য অনলাইন মিডিয়াগুলো যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। এসব ক্ষেত্রে তাদের যে শুধু জনগণকে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতে হচ্ছে তা নয়, তাদের পালন করতে হচ্ছে বিভিন্ন গুজব, মিথ্যা সংবাদ বা তথ্য বিকৃতি থেকে জনগণকে রক্ষার এক বর্ধিত দায়িত্ব। 
ডেঙ্গু প্রসঙ্গ দিয়েই আলোচনা শুরু করা যেতে পারে। এবারের ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এটি আবিষ্কৃত হলো যে এবারের ডেঙ্গু পূর্বেকার চেয়ে ভয়াবহ, জটিল এবং প্রাণহন্তারক। গণমাধ্যমের জন্য এ এক কঠিন পরিস্থিতি। তাদের জানাতে হচ্ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার ব্যাপ্তি, সঠিক পরিসংখ্যান, চিকিৎসা সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞ মতামত ইত্যাদি। তাদের নীতিনির্ধারকদের কঠিন সব প্রশ্ন করতে হয়েছে—টিভিতে সাংবাদিক কর্তৃক মেয়রদের কড়াকড়ি প্রশ্নের ভিডিও দেখে সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে আমি নিজেও হয়েছি গর্বিত। মনে হয়েছে গণমাধ্যম জনগণের মনের ক্ষোভগুলোই নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে। 

শুধু ডেঙ্গু নয়। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির সর্বশেষ তথ্য জানাতে হচ্ছে গণমাধ্যমকে। আমাদের দেশে দুর্যোগ বিষয়ক রিপোর্টিংয়ের একটি বড় অংশই জুড়ে থাকে উপদ্রুত এলাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিসংখ্যান আর ত্রাণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য, তথাকথিত ‘CNN Effect’ আমাদের দেশেও কাজ করে। অর্থাৎ গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হলেই সরকারি তরফ থেকে উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়। 

আবার দুধ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সিদ্ধান্তের খবর জানাতে গণমাধ্যমকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে। পদ্মা সেতুর জন্য শিশুর মাথা দেওয়ার ব্যাপারে গণমাধ্যমকে লেখালেখি বা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করতে হয়েছে। 

আমি দুটো কারণে মূলধারার গণমাধ্যমের দায়িত্বকে বর্ধিত বা অতিরিক্ত দায়িত্ব বলছি। প্রথমত এবারে ডেঙ্গু বা বন্যায় পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দেশের জনগণকে নিস্পৃহ বা নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন দুর্যোগে বা সংকটে পারস্পরিক সহমর্মিতার দৃশ্য দেখেছেন বিশেষত তরুণদের মধ্যে, তাদের কাছে এ নির্লিপ্ততা অসহনীয় ঠেকেছে। অনেকেই এটা নিয়ে লিখেছেন, আমিও ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছি। এ নির্লিপ্ততার কারণ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু একাধারে নির্লিপ্ত কর্তৃপক্ষ ও নিষ্ক্রিয় জনগণকে উদ্দীপ্ত করার দায়িত্ব নিতে হয়েছে আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমকে। 

দ্বিতীয়ত, ছেলেধরা, দুধের কার্যকারিতা নিয়ে বিতর্ক বা রিফাত হত্যায় মিন্নির সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বিষয়ে ভয়াবহ গুজব, তথ্য বিকৃতি ইত্যাদি মোকাবিলায় গণমাধ্যমকে বেশ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হয়েছে। গুজবের ব্যাপ্তিও এবার তার সীমা ছাড়িয়েছে। শিশুবলির ব্যাপার আর সেই সঙ্গে ছেলেধরার গুজব থেকে শুরু করে বেসিনে হারপিক দিয়ে ডেঙ্গু সমস্যার সমাধানের উদ্ভট পদ্ধতির বিরুদ্ধে সরব দেখা গিয়েছে আমাদের গণমাধ্যমকে। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও গেটকিপারের ব্যবস্থা না থাকায় এক শ্রেণির নাগরিক ফেসবুকসহ বিভিন্নস্থানে গুজব, অরুচিকর ও বিকৃত বিভিন্ন তথ্য ছড়াচ্ছেন। আমি নিজেই ফেসবুকে এক শিশুর কাটা মাথার ছবি দেখেছি। যারা এরকম করছেন তারা সবাই যে বুঝেশুনে এরকম করছেন তা হয়তো না। মিডিয়া, এর ব্যবহার ও প্রভাব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এক্ষেত্রে অবশ্যই কাজ করছে। শুধু আইন প্রয়োগ করেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের সাধারণ জনগণের গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা বা মিডিয়া লিটারেসি বৃদ্ধি। অনেক উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশে সেকেন্ডারি বা হায়ার সেকেন্ডারি পর্যায়ে মিডিয়া স্টাডিজ বা গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিষয়টি এখনই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলে আমি মনে করি।

এই কলামে আমি আগেও বলেছি, আমরা চাই দেশের গণমানুষের তথ্যপ্রাপ্তির বা এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নেতৃত্ব থাকতে হবে আমাদের মূলধারার প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা সাংবাদিকদের হাতে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে এ প্রয়োজনীয়তা আরো ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছে। আনন্দের বিষয় যে, আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমে সে দায়িত্ব পালনে সর্বদা সচেষ্ট আছে। যদিও মিডিয়া কনভার্জেন্সের যুগে সংবাদপত্র পঠন বা রেডিও টেলিভিশনের ক্ষেত্রে অনলাইন মিডিয়ার ওপরই সবাই নির্ভরশীল, কিন্তু তথ্যপ্রবাহের মূল জায়গাটি থাকতে হবে বিশ্বাসযোগ্য মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের কাছে। 

এক্ষেত্রে আরেকটি প্রবণতা লক্ষণীয়। অনলাইনে তথ্যপ্রবাহের সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর যেমন বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা বা ডয়েচে ভেলে ইত্যাদি সুপরিচিত মিডিয়ার পুনরুত্থান ঘটেছে। আমাদের দেশেও এদের জনপ্রিয়তা বেশ বাড়ছে। তবে একটি দেশে অন্যান্য দেশের গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি সেই দেশের গণমাধ্যমের সংকুচিত অবস্থাকে নির্দেশ করে। পশ্চিমা সুপরিচিত মিডিয়ার হাতে রয়েছে ব্যাপক সম্পদ, যা আমাদের দেশের মিডিয়ার ক্ষেত্রে অকল্পনীয়। তাদের রয়েছে বিভিন্ন দেশে সংবাদদাতা। এজন্য তারা যে কোনও ইস্যুতে একটি তাৎক্ষণিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে তুলনামূলক চিত্র পাঠকদের দিতে পারে। এজন্য তারা পাঠক ও দর্শকপ্রিয়তা পাচ্ছে।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলা বিভাগের একটি সংবাদ ‘কলকাতা যেভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল’ ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে, সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আমি নিজেও তাৎক্ষণিকভাবে তা ফেসবুকে শেয়ার করেছি। আমাদের পাশের শহর কলকাতার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা এখানে কলকাতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছেন। তবে পশ্চিমা মিডিয়ায় যা প্রকাশিত হয় তার অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও আমি লক্ষ করেছি কিছু কিছু সংবাদ আমাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী, যা আমাদের সামাজিক বিভাজনকে উসকে দিতে পারে। সুতরাং আমাদের লক্ষ থাকবে তথ্যপ্রবাহে দেশীয় মিডিয়ার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। 

মূলধারার মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা ব্যাপক হলেও কর্মক্ষেত্রে তাদের অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট আইনি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কাঠামোর পরিমণ্ডলে তাকে কাজ করতে হয়। তবে এটি মেনে নিয়েই মিডিয়াকে আরও গণমুখী হওয়ার প্রচেষ্টায় সার্বক্ষণিকভাবে সচেষ্ট থাকতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের জনগণের প্রত্যাশাকে আরো সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হবে—প্রয়োগ করতে হবে empathy বা সমানুভূতির গুণটি—অর্থাৎ পাঠক, দর্শকদের অবস্থানে গিয়ে তাদের চাহিদাকে জানতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ে আমি রিপোর্টগুলো পর্যালোচনা করে দেখছি অনেক সংবাদপত্র বা টিভিতে অনেক ভালো রিপোর্টের পাশাপাশি অনেক বাহুল্য কথাবার্তা রয়েছে, যা জনগণের তাৎক্ষণিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জনগণ জানতে চায় রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি, কোন হাসপাতালে সিট পাওয়া যাবে, কোথায় আইসিইউ আছে ইত্যাদি। এসব অতিপ্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে কোনও কোনও মিডিয়ার সীমাবদ্ধতা আমি লক্ষ করেছি। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সরকারি সেবাপ্রদান পদ্ধতি যেখানে শ্লথ, সেখানে মিডিয়াকেই অনেক দায়িত্ব কাঁধ পেতে নিতে হয়। এ সম্পর্কে ভবিষ্যতে আরো আলোচনা করা যেতে পারে। 

লেখক: কলামিস্ট

ইমেইল: shamsulbkk@gmail.com