এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিককর্মী বলে কেউ আছে কিনা, এনিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ কারও সামনে রাজনৈতিক আদর্শ নেই। কোনও নেতার প্রতি খাদহীন আনুগত্যও হয়তো নেই। সম্পদের ডাইনোসর হওয়া, ব্যক্তি হিসেবে নিজেই ব্যাংকের সমপরিমাণ তারল্যের মালিক হওয়া এবং পদ ও পদকের জন্য মৌসুম অনুযায়ী নেতা-নেত্রীর মুরিদ হওয়া, তাদের নামের বন্দনা করা এখন রাজনৈতিক দলের প্রতীক ও আদর্শ। পোশাক ভেদ করে হৃদয়ে পৌঁছে না।
রাজধানীতে ক্যাসিনো, মদ-সিসার বার, টর্চার সেল, চুনোপুঁটি নেতাদের অফিসে-বাড়িতে নগদে, চেকে কোটি কোটি টাকার হদিস, তাদের এক দুই হালি বন্দুকধারী নিয়ে চলাচল, কোনোটাই অপ্রকাশ্য ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পর, তাদের সঙ্গে ক্ষমতার যাদের ঘনিষ্ঠতার ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আঁতকে উঠিনি হয়তো আপনি-আমি—কেউই। ওই ঘনিষ্ঠজনেরা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে, সম্পদের ডাইনোসর হতে তাদের ব্যবহার করেছেন। পরগনার জমিদারি করতে গিয়ে যা কর আদায় হয়েছে, তার ভাগ-বাঁটোয়ারার অংশীদার তারাও। ক্ষমতায় থাকার এক যুগেরও বেশি সময় পাশাপাশি থেকেছেন। যখন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হলো–নির্মূল হোক এই ডাইনোসার। তখন ব্যস রেফ কারও নয়, ছিল না কোনোদিন। কিন্তু গণমাধ্যমে নানাভাবে এই ডাইনোসারের খামার মালিকদের নাম চলে এসেছে। এতে তারা বিচলিত, দিশেহারা। আতঙ্কে আছেন নিজেরাই কখন নির্মূলের তালিকায় উঠে যান।
আমরা বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে যাদের নামের যোগ পেয়েছি, তারা সমাজ, রাষ্ট্রকে শুদ্ধ করার বয়ান দিয়ে বেড়ান। কারও কারও নির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থানের। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম, তাদের পাহারা ও প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নামধারীরা কোটি টাকা গুনতে গুনতে ক্লান্ত। এই কাণ্ড বিএনপি, জাতীয় পার্টির সময় হয়েছে বলে এখনও চলবে—এই সাফাই গাইছেন তারা। পনেরো বছর ধরে এ ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে তারা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দেশের রাজনীতির বড় ক্ষতি করেছেন। এজন্য যারা আতঙ্কবোধ করছেন, সরকারের উচিত—তাদের সেই আতঙ্ককে সত্যে রূপ দেওয়া।
এক সময় ঢাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম শোনা যেতো। আলোচিত ছিল ২৩ সন্ত্রাসীর নাম। এখন কোনও নির্দিষ্ট সংখ্যার কথা শোনা যায় না বলে মনে করা ঠিক হবে না যে, তারা নেই। তারা আছে, সংখ্যা হয়তো গুনে শেষ করা যাচ্ছে না। এরা স্মার্ট প্রজন্ম, তাই চিৎকার করে তারা মার্কেট নিতে চায় না। রাজনৈতিক, ক্ষমতা প্রশাসনকে সহোদর করেই কারা সাম্রাজ্য চালাতে চায়। এই সাম্রাজ্যের দড়িতে টান পড়েছে, খেয়াল রাখতে হবে সাম্রাজ্যই যেন খানখান হয়। ওরা দড়িকেই খানখান করার চেষ্টা করবে, করছেও। আমরা রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির অনমনীয় অবস্থান দেখতে চাই।
সরকারের দিক থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ যেই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। এই জোর গলার ওপর এখনও আম মানুষ যে ভরসা করছে, তা বলা যাবে না। এক ধরনের সংশয় কাজ করছে তাদের মধ্যে। কারণ অতীতে এমন অযুত অভিযান তারা লক্ষ করেছে, যেগুলো ‘পুঁটি-বইচা’কে জালে আটকাতে আটকতেই শেষ। এক-দু’টির বেশি পুঁটি জালে ধরাও পরেনি। ‘বোয়াল’ আর ‘বাঘা আইড়’ রয়ে গেছে নিরাপদ অ্যাকুরিয়ামে। নিকট অতীতের মাদক, ভেজাল, নকলের বিরুদ্ধে অভিযান থেকে জন মানুষের মধ্যে এই অনাস্থাই তৈরি হয়েছে। তাই এবারও তাদের প্রশ্ন ‘বাঘা আইড়’ রা কি এবারো অ্যাকুরিয়ামেই রয়ে যাবে? রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের উচিত জনআস্থা ফেরাতে অ্যাকুরিয়ামের রঙিন জলের দিকে নজর রাখা।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি