দুর্নীতি কি শুধু ক্যাসিনোতেই চলে?

সারওয়ার-উল-ইসলামশুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা—সবকিছুর শেকড় সন্ধানে তৎপর সরকার। মন্ত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় বলে বেড়াচ্ছেন, দুর্নীতিবাজ যেই হোক, চাঁদাবাজ যেই হোক, ক্যাসিনোব্যবসায়ী যেই হোক, কোনো ছাড় নেই। বিশেষ নজরে আছে ঢাকা শহরের বেশকিছু এলাকা।
এক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াই যেন সবার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গেলেন। ‘রিলে রেস’-এর মতো ঘটনা ঘটলো একের পর এক। শুদ্ধি অভিযান অনেককে তটস্থ করে তুললো। আবার অনেককেই সচেতন করে দিলো—খবরদার! বেশি খেতে যেও না, খেলেই ধরা।
এই শুদ্ধি অভিযান কতদিনের? সেই ব্যাপারেও মন্ত্রীরা বলেছেন, যতদিন দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বন্ধ না হবে, ততদিন চলবে।
কথা হচ্ছে, দুর্নীতি কি শুধু ক্লাবের ভেতরেই চলে? ক্যাসিনো বা জুয়ার বোর্ডেই টাকা কামানো বা অবৈধভাবে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়েই দুর্নীতি হয়েছে?

কারা এই দুর্নীতিবাজ বা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া বা জি কে শামীম বা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটদের এই টাকা কামানোর পথকে সুগম করে দিয়েছেন? তাদের ক’জনকে চিহ্নিত করা গেছে? তাদের পরিচয় কেন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হচ্ছে না? 

হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ জি কে শামীম কীভাবে পেলেন? কারা পাইয়ে দিলেন? সরকার প্রধান বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধানদের কত কাছের মানুষ ছিলেন এই শামীম, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজর রাখলেই বোঝা যায়। 

জি কে শামীম কি একদিনেই এত কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন? একদিনেই কি দেশের বড় বড় ঠিকাদারি কাজ করার মতো যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছেন? 

কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক রঙ ছড়ানোর চেষ্টা করেছে—অমুক একসময় বিএনপি করতো, তমুক একসময় ফ্রিডম পার্টি করতো। তার মানে কি তারা সরকারি দলের কেউ না, এটা প্রমাণ করার কেন এই খোঁড়া যুক্তি বা অপচেষ্টা? বলা যায় দায় এড়ানোর বিষয়টাও হাস্যকর?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী পরিমাণ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ এই যুবলীগ-ছাত্রলীগ, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর, তা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধুর রক্ত তার ধমনীতে বহমান, এটা প্রমাণ করে দিলেন। 

প্রধানমন্ত্রী এই কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছেন নিজের দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধেই। নিজের দলে সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার কথাটি ভাবেননি প্রধানমন্ত্রী। বদনামের কথা না ভেবেই তিনি নাম বলেছেন জনসমক্ষে। তাদের কর্মকাণ্ডও তুলে ধরেছেন। তার কাছে নিজ দলের কেউ অপরাধ করলেও অপরাধ, এটাই প্রমাণ করলেন। এর দ্বারা প্রমাণ করেছেন তার সরকার কাউকে আর ছাড় দেবে না। নিজের দলের হলেও মাফ নেই।

এখন প্রধানমন্ত্রী বরাবর সাধারণ মানুষের দাবিটা আরও বেড়ে যাবে—কোন মন্ত্রী কোটি কোটি টাকা নিতেন এই খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার কাছ থেকে, কোন প্রভাবশালী নেতা জি কে শামীমকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য বখরা নিতেন নিয়মিত, কোন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য চাঁদা তুলতেন ওইসব ক্যাসিনো থেকে, পাশাপাশি এটাও আজ প্রশ্ন উঠেছে সাংবাদিকরা কত টাকা করে মাসোহারা পেতেন, যে কারণে একবারও ওই বিষয়ে পত্রিকা বা টেলিভিশনে খবর প্রকাশিত হয়নি, সেই ব্যাপারেও গ্রহণযোগ্য তদন্ত জরুরি। আর সেটা সম্ভব শুধু প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেই, অন্য কারও পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, এটাও প্রমাণিত হয়ে গেছে।

শুদ্ধি অভিযান জরুরি সবখানে। প্রধানমন্ত্রী, আপনার দলের প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হিসাবের ব্যাপারে আপনি সোচ্চার, খুবই আশাব্যঞ্জক সিদ্ধান্ত। কিন্তু আপনার সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা যেসব প্রতিষ্ঠানে সিবিএ নেতা আছেন, তাদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ, ভূমি অফিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা—এসব প্রতিষ্ঠানে ঘুষখোর কর্মকর্তাদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ কত, সে ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া দরকার। তাহলেই সাধারণ মানুষের মনে আপনি একটু হলেও স্বস্তি দিতে পারবেন।

জনসমক্ষে শুধু খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম, বা সম্রাট নাম এলেই চলবে না। অমুক মন্ত্রী, তমুক সংসদ সদস্য কিংবা ওয়াসার তমুক প্রকৌশলী, বিদ্যুতের অমুক সিবিএ নেতা, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অমুক কর্মচারী-কর্মকর্তা, তিতাস গ্যাসের তমুক ঠিকাদারের দুর্নীতির খবর বের করার জন্য নির্দেশ দিতে হবে। মানুষকে কীভাবে জিম্মি করে, বলা যায় গলায় পাড়া দিয়ে এসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে অফিস খরচের কথা বলে টাকা আদায় করে রক্তচোষাদের মতো।

ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় সম্প্রতি ফুটপাতগুলো খালি খালি দেখা যায়। এর থেকেই আরেকটি বিষয় প্রতীয়মান হয়েছে—বিভিন্ন ওয়ার্ডের সরকারি দলের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুলিশের সহায়তায় ফুটপাতে দোকান বসিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলতো এতদিন। যেই শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে, তখন থেকেই যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ফুটপাত থেকে দোকান সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এতে করে স্থানীয় কাউন্সিলররা নিজেদের ধোয়া তুলসী পাতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। পরোক্ষভাবে এটাও প্রমাণিত হয়েছে, এতদিন তারা অবৈধভাবে টাকা কামিয়েছেন। এখন শুদ্ধি অভিযানে ধরা খাওয়ার ভয়ে নিজেদের তৎপরতায় দোকান তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু যারা এতদিন ফুটপাতে দোকান বসিয়ে ব্যবসা করেছেন, তারা পড়েছেন বিপদে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শুদ্ধি অভিযান চলুক সবখানে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়া দুর্নীতির আমূল উৎপাটনে আপনি থাকুন অবিচল। বাংলার জনগণ আপনার পক্ষে থাকবে। আর সেই নামগুলো প্রচার করুন, যারা কোটি কোটি টাকা বখরা নিয়েছেন খালেদ-জি কে শামীম ও সম্রাটদের কাছ থেকে। হোক তা যতই অপ্রিয়।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক