‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড

আমীন আল রশীদযখনই বড় কোনও অপরাধ হয়, সাধারণ মানুষের তরফে এর দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। কিছুদিন আগে পরপর কয়েকটি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের খবর যখন গণমাধ্যমের শিরোনাম হলো, তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে লিখেছিলেন, ‘ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া হোক’। ওই সময়ে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। সবশেষ ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলার রায়ে ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং দ্রুততম সময়ে এই মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। ফলে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, ন্যায়বিচারের মানদণ্ড আসলে কী এবং একটি ঘটনায় যখন দ্রুত বিচার নিশ্চিত হয়, তখন একইরকম আরও অনেক ঘটনার কেন বিচার হয় না? এক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো নিয়ামক হিসেবে কাজ করে? তাছাড়া ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষেও জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
নুসরাত হত্যার ঘটনাটি নিয়ে শুরুর দিকে কিছু ধোঁয়াশা ছিল। বলা হচ্ছিল এটি আত্মহত্যা। কিন্তু থলের বেড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে এবং সোনাগাজী মাদ্রাসার বরখাস্ত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তাও আসামিদের জবানবন্দিতে উঠে আসে। যদিও এই ঘটনার অন্যতম ক্রীড়নক সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, যিনি শ্লীলতাহানির বিচার চাইতে যাওয়া নুসরাতের বক্তব্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাকে এই চাঞ্চল্যকর মামলায় আসামি করা হয়নি, এমনকি পিবিআইয়ের তদন্তেও ওসির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সেভাবে আসেনি। নুসরাতের পরিবার থেকেও সম্ভবত ওসি মোয়াজ্জেমকে আসামি করার দাবিটি জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়নি এ কারণে, তারা ভেবেছিলেন পুলিশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তারা সুবিধা করতে পারবেন না। যদিও ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে নুসরাত ইস্যুতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে রয়েছেন।

এই চাঞ্চল্যকর মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার পেছনে প্রধানত দুটি কারণকে চিহ্নিত করা হয়—১. এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল এবং ২. মামলাটি তদন্ত করেছে পুলিশের তদন্ত ব্যুরো পিবিআই। এরই মধ্যে চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার তদন্তে পিবিআই তাদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। যদিও এ বিষয়ে ভিন্নমতও আছে। যেমন—গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ২০১৬ সালের নভেম্বরে সাঁওতাল পল্লিতে হামলার ঘটনায় ৯০ জনের বিরুদ্ধে পিবিআই সম্প্রতি যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে, সেখানে পুলিশের সম্পৃক্ততা নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ ওই ঘটনার ছবি ও ভিডিও বলছে অন্য কথা। যে কারণে পিবিআইয়ের এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন সাঁওতালরা এবং এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদনও দাখিল করা হয়েছে। ফলে যে প্রশ্নটি আসে, যেকোনও বড় ঘটনার তদন্তে রাষ্ট্রের চাপ তথা রাজনৈতিক অবস্থান কোনও প্রভাব বিস্তার করে কিনা? যদি করে, তাহলে অবশ্যই সেটি ন্যায়বিচার ও স্বাধীন তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করবে।

রাজনীতির বাইরে এখন আরেকটি চাপপ্রয়োগকারী গোষ্ঠী সোশ্যাল মিডিয়া বা আরও পরিষ্কার করে বললে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। যে ঘটনায় ফেসবুক তোলপাড় হয়, সেই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে, যার একাধিক উদাহরণ এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ‌ চাপ মূলধারার গণমাধ্যমের জন্যও চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। ফলে কোনও ঘটনার তদন্ত ও বিচারে সামাজিক ও গণমাধ্যমের এই চাপও কতটা প্রভাবিত করে, তা নিয়েও অ্যাকাডেমিক তর্কের প্রয়োজন আছে। কারণ তদন্তকারী এবং বিচারকরা সমাজের বাইরের কেউ নন।

তবে যে প্রশ্নটি এই ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব বেশি করে আসছে তা হলো, সরকারের শীর্ষ মহলের আন্তরিকতায় নুসরাত হত্যা মামলার দ্রুত বিচার কিংবা বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলার আসামিরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধরা পড়লেও কুমিল্লার কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু কিংবা সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার বিচার কেন হচ্ছে না? এই ঘটনাগুলোয় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা নেই বলে? সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দিতে এ পর্যন্ত ৬৮ বার সময় নিয়েছে তদন্তের দায়িত্বে থাকা র‍্যাব। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ উচ্চ আদালতও। ফলে একটি ঘটনায় দ্রুত বিচারকে মানুষ যেমন স্বাগত জানায়, তেমনি অপরাপর ঘটনাগুলো বছরের পর বছর ধরে অনিষ্পন্ন বা রহস্যাবৃত থাকলে তা নিয়েও মানুষ সন্দেহ করে, যা ন্যায়বিচারের অন্তরায়।

২.

বড় ধরনের অপরাধ হলেই মানুষ এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়। তারা এমন শাস্তি চায় যাতে এ ধরনের অপরাধ করতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস না পায়। যেমন—ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে অনেকেই মনে করেন ‘ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে দেওয়া উচিত’। কিন্তু একটি বর্বরতার শাস্তি আরেকটি বর্বরতার মাধ্যমে হয় কিনা, সেটিও প্রশ্ন। যে কারণে বিশ্বের বহু দেশ ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করেছে। পক্ষান্তরে বিচারের মানদণ্ডটি যদি ভুক্তভোগীর জায়গায় বসে দেখা হয় তখন এটির ডাইমেনশন আলাদা। যেমন যার সন্তান ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বা যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তিনি ধর্ষকের হয়তো আরও বড় শাস্তি চান। নুসরাতের স্বজনরা হয়তো শুধু খুনিদের মৃত্যুদণ্ডই নয়, আরও কঠিন কোনও শাস্তি চাইবেন। কিন্তু মানবাধিকারকর্মীরা বলবেন মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে। ফলে আমরা যখন ন্যায়বিচারের কথা বলি, তখন সেখানে এই পারসপেকটিভগুলোও মাথায় রাখা দরকার। সেই সঙ্গে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আনা দরকার তা হলো, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই কি সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অপরাধ চিরতরে নির্মূল হয়ে যায়? সমাজ ও রাষ্ট্রে অপরাধ করার বা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সব দরজা খোলা রেখে শুধুমাত্র দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অপরাধমুক্ত সমাজ গঠন করা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নও তোলা দরকার।

মানুষ কেন অপরাধে জড়ায়? এর একটি বড় কারণ সে মনে করে অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে। কেননা অতীতে তাই হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে এখনও তাই হয়। পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ নামে এক দর্জি দোকানিকে যে তরুণরা প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তারা জানতো এই ঘটনা কারও না কারও ক্যামেরায় বন্দি হবেই। বুয়েটের যে শিক্ষার্থীরা তাদের সহপাঠীকে পিটিয়ে হত্যা করলো, তারাও কি জানতো না কোথাও কোথাও সিসি ক্যামেরায় তাদের গতিবিধি রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে? হয়তো জানতো। কিন্তু তাদের মনে এই বিশ্বাস ছিল, তাদের কিছুই হবে না। কারণ তারা ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে আছে। যুগে যুগে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষেরাই অপরাধে জড়ায়। সুতরাং সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির চেয়েও বেশি জরুরি ক্ষমতার এই বলয় বা বৃত্তকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করা।

ক্যাসিনো ইস্যুকে ধরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে বড় ধরনের অভিযান চলছে এবং যে অভিযানের জালে ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষগুলোও ধরা পড়ে যাচ্ছে, এটি অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এটি একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করবে। কারণ অপরাধীদের মনে তখন এমন একটি প্রতীতি জন্মাবে যে, আজ কোনও অন্যায় করলে কোনও না কোনোদিন হয়তো এর মাশুল গুনতে হবে।

৩.

বিচার মানেই ন্যায়বিচার। এর বিপরীত শব্দ অবিচার। কিন্তু বিচার কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত এর কোনও মূল্য নেই। তাছাড়া বিচারকে দৃশ্যমান হতে হয়। মানুষকে জানাতে হয় বিচারটি সুসম্পন্ন হয়েছে যাতে অন্যদের মনে ভয় ঢোকে। মানুষ যদি আইনকে ভয় না করে, অপরাধ করলে একদিন না একদিন শাস্তি পেতেই হবে, এই বিশ্বাস ও বোধ যদি তার মনের ভেরে গেঁথে না যায়, তাহলে সুযোগ পেলেই সে অপরাধ করবে। তাছাড়া ন্যায়বিচার যে হয়েছে এটিও মানুষের মনে গেঁথে দিতে হয়। মানুষ যদি মনে করে এখানে বিচার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি পক্ষপাতদুষ্ট বা কোনও কোনও অপরাধী বিশেষ কারণে লঘু দণ্ড পেয়েছে এবং মানুষ যদি মনে করে বিচারিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়েছে, তাহলে সেই বিচারের শাস্তি যতই দৃষ্টান্তমূলক হোক না কেন, জনআস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। সুতরাং বিচার হওয়াটা যেমন জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি সেখানে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আরও জরুরি সেই বিচারকে সর্বজনগ্রাহ্য এবং দৃশ্যমান করা যাতে কোনও ধরনের পক্ষপাতিত্বের সংশয় তৈরি না হয়। মানুষ যেন বলতে না পারে, শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ওমুক ব্যক্তি ন্যায়বিচার পাননি বা অবিচারের শিকার হয়েছেন। জনমনে এই প্রশ্ন থাকলে ধরে নিতে হবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়নি। তবে এটা ঠিক, প্রতিটি বিচারে যেহেতু প্রধানত দুটি পক্ষ থাকে, তাই একটি পক্ষ সব সময়ই সংক্ষুব্ধ হবে। কিন্তু কোন বিচারটি সঠিক হলো আর কোনখানে অবিচার হলো সেটি বোঝার মতো জ্ঞানবুদ্ধি নাগরিকদের থাকে। বিচারের প্রক্রিয়াটিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

নারায়ণগঞ্জে যে সাতজন মানুষকে খোদ র‍্যাব সদস্যরাই খুন করেছিল,তাদের মনে হয়তো ভয় ছিল না কিংবা তারা মোটা অঙ্কের টাকার কাছে এতটাই বিকিয়ে গিয়েছিল যে, ওই ভয়ের বিষয়টি তাদের বিবেচনাতেই আসেনি। এখন কারাগারের প্রকোষ্ঠে তারা হয়তো অনুশোচনা করছে। কিন্তু যে বা যারা র‍্যাব সদস্যদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এত বড় একটি অন্যায় করালো সেই টাকার উৎস কী এবং কারা এভাবে অবৈধ টাকার মালিক হয়? রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় কেউ অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা কামাতে পারে না। সুতরাং আমরা যখন সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূলের কথা বলি, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কথা বলি, তখন অবৈধ পথে টাকা রোজগার এবং সেখানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠাপোষকতার প্রশ্নটিও তোলা দরকার।

রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে চলে? তাদের নির্বাচনি তহবিলে শত শত কোটি টাকা কারা দেয়? বৈধ পথে বা রক্ত পানি করা হালাল পয়সা কেউ রাজনৈতিক দলের তহবিল গঠনের জন্য দেয়? সুতরাং একাধিক অন্যায়ের পথ খোলা রেখে শুধুমাত্র ধর্ষকের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা কিংবা খুনিকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় বটে, কিন্তু এর মাধ্যমে সমাজ অপরাধুমক্ত হয় না। নেদারল্যান্ডসে কারাগার বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। কারণ সেখানে অপরাধী নেই। আর আমাদের দেশে কারাগারে ঠাঁই নেই। নতুন নতুন ভবন তৈরি করতে হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে হাজার হাজার বন্দির ভারে কারাগারগুলোয় মানবিক সংকট তৈরি হয়। সুতরাং রাষ্ট্রীয় কাঠামো ঠিক না করে শুধু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর