উল্লাসে আড়াল আবরারের মৃত্যু

তুষার আবদুল্লাহসংশয় নিয়ে লিখছি। লেখাটি শেষ পর্যন্ত মুক্তি পাবে তো? সংশয় এজন্য—খবর, সাংবাদিকতা এখন গোষ্ঠীর বৃত্তে বন্দি। ফলে অনেক খবর, লেখার আঁতুড়ঘরে মৃত্যু ঘটে। অনেক দ্বিধা, লড়াই শেষে কোনও কোণে খবর আলোর মুখ দেখলেও, তা অনাদরে রয়ে যায় এতটাই যে—দর্শক, পাঠকের নজরে পড়ে না। তারপরও লিখছি। কারণ যেখানে লিখছি সেই মাধ্যম ঘটনাটি লুকোয়নি, প্রকাশ করেছে। সকালে দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতা, নাহলে শেষের পাতায় খবরটি দেখার স্বপ্ন ছিল। পত্রিকা খুলে দেখি সত্যিই দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। যাদের অনুষ্ঠান বা ইভেন্টে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে, ভরসা রেখেছিলাম পাঠকের বিক্ষুব্ধ বা বেদনার মনে, চোখে প্রলেপ দিতে হলেও খবরটি প্রথম পাতায় জায়গা পাবে। পায়নি, হন্যে হয়ে খুঁজে পাওয়া গেলো পাঁচ-এর পাতায়। অন্যান্য পত্রিকায়ও এই খবর খুঁজতে গিয়ে ক্লান্ত হতে হয়েছে পাঠকদের। দৃশ্যমাধ্যমের অনেকেই নীরব। কারণ পারস্পরিক স্বার্থের বিষয় আছে। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরারের মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে মেনে নেওয়া যেতো। হয়তো দুর্ঘটনাই এটি। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ঘটনা যেকোনোভাবে ঘটতেই পারে। অনেক সাবধানতা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা ঘটার নজির আছে। কিন্তু এখানে ওই আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের অভিযোগ—বিদ্যুৎ সরবরাহের জেনারেটরের তার উন্মুক্ত ছিল এবং এলোমেলোভাবে ছড়ানো ছিল। আয়োজকদের এধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের অজুত অভিজ্ঞতা আছে। ওই বিদ্যায়তনেও তারা এমন আয়োজন করেছেন অসংখ্যবার। তাই বলে এবারের আয়োজনে অতি আস্থাজনিত কারণে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটু হেলাফেলা ছিল?

আবরার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পর, তাকে দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ মূলত হাসপাতাল অঞ্চলেই অবস্থিত। উল্টোদিকেই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল। সেখানে না নিয়ে তাকে কেন স্পন্সর হাসপাতালে পাঠাতে মহাখালী পর্যন্ত নিয়ে যেতে হলো? আয়োজকদের সাফাই—আবরারকে অনুষ্ঠানস্থলেই দুজন এফআরসিএস চিকিৎসক দেখেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন এই সাফাই পাঠে। কারণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট কাউকে দেখার জন্য সাধারণ মেডিক্যাল অফিসার যথেষ্ট। দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে সমন্বিত চিকিৎসা দেওয়াটাই জরুরি ছিল। সুতরাং অবহেলা বা ব্যবস্থাপনার গাফিলতি এখানেও।

রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থীসহ সাধারণের ক্ষোভের বড় আরেকটি কারণ—অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্ব বা পুরো আয়োজন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা খবরটি চেপে গেছেন। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের জানাননি। জানালে হয়তো অনুষ্ঠান থেমে যেতো। স্পন্সর বেঁকে বসতো। বকেয়া টাকা পরিশোধ করতো না। কিংবা পরের ইভেন্টে আসতে গড়িমসি করতো। ভেস্তে যেতো বাণিজ্য। তাই অনুষ্ঠানের উল্লাস-আনন্দে তারা ভাটা টানেননি। যে পত্রিকার নামে অনুষ্ঠান, তার ভোক্তা আবরার। আবরারদের জন্যই পত্রিকাটি নানা প্রতিশ্রুতি, জীবন গড়ার রকমারি বাণী নিয়ে প্রকাশিত হয়। তাই যার বা যাদের জন্য এই পত্রিকা, সেই বয়সী একজনের মৃত্যু হলো ওই পত্রিকার অনুষ্ঠানে, তার জন্য সুরের ঝংকার থেমে গেলে, ওই পত্রিকার প্রতি পাঠকদের ভালোবাসা বাড়তোই।

আচ্ছা এমনও তো হতে পারতো, আবরারের মৃত্যু হয়নি। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত, এই খবরটিও তো অন্য শিশু-কিশোরদের জানানো প্রয়োজন ছিল। যেন তারা সাবধান হয়ে যায়। আরেকটি দুর্ঘটনা যেন না ঘটে। এটি যেকোনও আয়োজকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু তারা খবরটি লুকিয়ে গেলেন।

 

হইহুল্লোড়ের আড়ালে আবরার মারা গেলো বা উল্লাস দিয়ে আবরারের মৃত্যুকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো। যারা ওই অনুষ্ঠানে ছিল, সেই শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যে সাতটার দিকে খবরটি জানে। আয়োজকরা বলছেন তারা সারাজীবন আবরারের পাশে থাকবেন। এগুলো ছেলে ভুলানো কথা। আবরারের মা ও বাবা আপনাদের দিয়ে কী করবে? ছেলের জায়গা আপনারা নেবেন কী করে? আবরারের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও অভিযোগ করা হয়নি পুলিশের কাছে। পুলিশে মামলা হলে ছেলের বুক কাটা হবে, তা সইতে পারবেন না বলেই হয়তো। পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়নি। এছাড়া আয়োজকদের বড়ত্বের প্রভাবও থাকতে পারে। তবে এই ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে মেনে নিয়েও শেষ পর্যন্ত একটা আফসোস রয়েই যায়—যারা হলি আর্টিজানে নিহত ফায়াজের মানবিকতাকে ব্র্যান্ডিং করে মানবতার আলো অনির্বাণ রাখতে চান, তারা আবরারের মৃত্যুর খবরটি প্রথম পাতায় এনে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতেন। করেননি বলে আলোটা কেমন ঝাপসা হয়ে গেলো।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি