ট্রেনের বাড়ি কই?

বিনয় দত্তশামসুর রাহমানের ‘ট্রেন’ ছড়াটি নিশ্চয় সবার মনে আছে? ঝক ঝক করে যে ট্রেন ছুটে চলেছে মাঠের মাঝে বাজনা বাজিয়ে, সেই ট্রেন ছিল মজার, আনন্দের। সেই ট্রেন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে হলে বাঁশি বাজায়, খুক করে কেশে দেয়। শামসুর রাহমানের ছড়াটি পড়ে ট্রেন সম্পর্কে যে মজার ধারণা পাওয়া যায়, বাস্তবে কি ট্রেন সেই রকম? এই সময়ে ট্রেন চকচকে, ঝকঝকে কিন্তু দোষের ভারে জর্জরিত। অসংখ্য সমালোচনা নিয়ে সে নত। এই অসংখ্য সমালোচনা আর দোষের ভার নিয়ে আজকের ট্রেনকে প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্ত পার করতে হয়। দোষ কিন্তু ট্রেনের নয়, এর ব্যবস্থাপনায় যারা রয়েছেন, দোষ মূলত তাদের। কেন এই দোষের ভার? আমরা জানবো একটু পর।

ঢাকায় আমাদের বাসাটা ট্রেন লাইন থেকে একটু দূরে। আমাদের বাসার জানালা থেকে ট্রেন দেখা যায়। ঢাকা থেকে যত ট্রেন বের হয় সবই দেখা যায়, শুধু নারায়ণগঞ্জের ট্রেন ছাড়া। আমার দুই বছরের মেয়ে আলতো আলতো বোলে বলে, বাবা ট্রেন কোথায় যায়? আমি তাকে বোঝানোর জন্য বলি, ট্রেন বাড়ি যায়। বাড়ি যাওয়া সেই ট্রেনের গল্প আমরা এখন সবাই জানি। গত ১১ নভেম্বর ২০১৯ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেল ক্রসিংয়ে তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে সংঘর্ষে ১৬ জন প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ১৪ নভেম্বর ২০১৯ সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে আগুন ধরে যায়। এতে ২৫ জন আহত হন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কোটি টাকার ওপরে। এর আগে, গত ২৩ জুন ২০১৯ রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেসের ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পাঁচ যাত্রী মারা যান। আহত হন শতাধিক।

পৃথিবীতে নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে ট্রেন অন্যতম। ট্রেনের ওপর নির্ভর করে একটি দেশের যোগাযোগ কত উন্নত হয়েছে, তার নজির রয়েছে। ভারত, চীন, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া তার যথাযথ উদাহরণ। কিন্তু আমাদের দেশে কেন এই চিত্র? আমাদের দেশে রেলের এই অবস্থা কেন, তা জানার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। বাংলাদেশ রেলওয়ে বা ট্রেন সংক্রান্ত খবর পত্রিকায় পড়লেই জানা যায়।

রেলের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ট্রেন দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে লাইনচ্যুতি। আর বেশি মানুষ মারা গেছে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে যানবাহনের সংঘর্ষে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে ট্রেনের ৬৩৯টি লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার ৭৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। রেলওয়ের বিভিন্ন থানার তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৫ মে পর্যন্ত রেলপথে প্রাণ হারিয়েছেন ২ হাজার ৪৪৬ জন। এরমধ্যে অর্ধেকের বেশি প্রাণহানি ঘটে ঢাকায় অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র বলছে, রেলে গত এক দশকে বড় প্রকল্পে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এর বেশিরভাগই নতুন রেললাইন নির্মাণের। প্রকল্পে ব্যাপক অপচয় ও দুর্নীতির অভিযোগও আছে। ফলে পুরনো রেললাইন জরাজীর্ণই রয়ে গেছে। লোকবল নিয়োগ হলেও তাদের ব্যবহার ঠিকঠাক হচ্ছে না। রেলে যাত্রীসেবা যেমন বাড়ছে না, তেমনি বাহন হিসেবেও পুরোপুরি নিরাপদ হয়নি।

বিষয়টা একদমই সহজ, যে জায়গায় পুরনো ট্রেন লাইনে ঘাটতি রয়ে গেছে, সেই জায়গায় পুরনো ট্রেন লাইন সংস্কার না করে নতুন করে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে নতুন ট্রেন লাইন নির্মাণে। কেন? কারণ নতুন করে ট্রেন লাইন নির্মাণ করতে গেলে অর্থের অংকটা বড় হবে আর অর্থের অংক বড় হলেই অপচয় ও দুর্নীতি সমান তালে করা যাবে। আর পুরনো ট্রেন লাইন সংস্কার করতে গেলে তো অর্থের অংক ছোট হয়ে যাচ্ছে, ফলে অপচয় ও দুর্নীতি সেভাবে করা যাবে না। মজার ব্যাপার হলো, এই বিশ্লেষণটি সবাই দিচ্ছেন। যারা যোগাযোগ খাত নিয়ে গবেষণা করেন, তারা প্রত্যেকেই একই ব্যাপার বলছেন। আর পুরনো ট্রেন লাইনে যে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, সেই ঘাটতির কারণে তো যেকোনও সময় তা দুর্ঘটনার শিকার হবে, এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে রয়েছে আবার অবৈধ লেভেল ক্রসিং। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, পূর্ব ও পশ্চিম রেলে দুই হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং আছে। তার মধ্যে অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং ১ হাজার ৭৬১টি। প্রায় ৭০ শতাংশ লেভেল ক্রসিংই অবৈধ। অন্যদিকে বৈধ ক্রসিংয়ের ৪৬৬টিতে গেটম্যান আছে। সারা দেশে রেলওয়ের অবৈধ লেভেল ক্রসিং আছে ১ হাজার ৮৫টি। অথচ অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো দেখার মতো কোনও গেটম্যান নেই। ফলে লোকজন যখন-তখন যাতায়াত করার ফলে বা গাড়ি চলাচলের কারণে দুর্ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দুর্ঘটনার দু’টি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, মানবিক ভুল; দ্বিতীয়ত, কারিগরি ত্রুটি। গড়ে ৮০ শতাংশের বেশি দুর্ঘটনার জন্য মানুষের ভুলই দায়ী। অর্থাৎ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের ভুলে বা অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এখন এই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি দায়িত্ববান না হন, তবে এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ অসম্ভব।

দুই.
বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি রেললাইন স্থাপনের মধ্য দিয়ে সূচনা হয় রেল যুগের। স্বাধীনতার সময় রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। এখন ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। স্বাধীনতার সময় রেললাইন ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ কিলোমিটার। বর্তমানে রেললাইন আছে ৪ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। স্বাধীনতার পর উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলাদেশ যে রেললাইন পেয়েছে, ৪৫ বছরে তা বেড়েছে মাত্র ১৯ কিলোমিটার। আর বিভিন্ন কারণে রেলপথ কমেছে।

তবে রেললাইন বা রেলপথ কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে রেলের লোকসানের কোনও সম্পর্ক নেই। প্রায় সারাবছরই ট্রেনের টিকেট না পেয়ে বাসে চলাচল করে গন্তব্যের ফিরছেন এইরকম লোক পাওয়া যায়। যিনি যখনই যাচ্ছেন, ট্রেনের টিকিট পাচ্ছেন না। তার মানে, ট্রেনের সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশ রেলওয়ে কেন লোকসানে থাকবে? সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে জানিয়েছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশ রেলওয়ের নিট লোকসান ছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। ওই অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ২৮৯ কোটি ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ১৪২ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রেলে যাত্রী ছিল ৭ কোটি ৭৮ লাখ। এই বিশাল অঙ্কের যাত্রী রেলে যাতায়াত করার পরও রেলখাত লোকসান গুনছে। বড় কারণ দুর্নীতি।

রেলের দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই দুর্নীতি বন্ধ করা না গেলে এই খাতে উন্নয়ন অসম্ভব। সম্প্রতি রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের হাতে রেলের দুর্নীতির ১০টি উৎস তুলে দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান। তা হলো:

১. চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর (পূর্বাঞ্চল) অধীনে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লিজ ও হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি।

ক. জলাশয় লিজ দেয়া খ. রেলের জমিতে অবৈধ স্থাপনা গ. রেলের শত শত একর জমি জমি বেহাত।

২. লোকোমোটিভ, কোচ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয় ও সংগ্রহ।

৩. সিগন্যালিং ব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিকায়ন।

৪. ডাবল ও সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ কাজ।

৫. রেলের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ।

৬. রেলের কারখানা সংস্কার, যন্ত্রাংশ বিক্রয় ও সংস্থাপন।

৭. ওয়ার্কশপ ও স্লিপার ফ্যাক্টরি কার্যকর না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি।

৮. রেলের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে টিকিট বিক্রিতে ব্যাপক কালোবাজারি।

৯. যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দেওয়া।

১০. ট্রেনে নিম্নমানের খাবার দিয়ে বেশি দাম নেওয়া।

মজার ব্যাপার হলো, এই দশটি পয়েন্টের আট নম্বর পয়েন্টটিতে লোকসানের বড় কারণ বলা আছে। যদি রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ট্রেনের টিকেট বিক্রিতে কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাহলে সেই টাকার হিসাব কখনোই সঠিকভাবে জমা হবে না। এভাবে চলতে থাকলে রেল কেন রাজার অর্থভাণ্ডারও নিমেষেই খালি হতে বাধ্য।

তিন.

আমি যখনই ঢাকার বাইরে যাতায়াত করি, প্রথমেই ট্রেনের টিকিটের সন্ধান করি। কারণ ট্রেনে যাতায়াত আরামদায়ক ও নিরাপদ। আমার মতো দেশের সব যাত্রীই ট্রেনের ওপর ভরসা করেন। আর ভরসা করেন বলেই বছরে কোটি কোটি যাত্রী ট্রেনে যাতায়াত করেন। সেই যাতায়াত যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে সব যাত্রী ট্রেন থেকে বিমুখ হয়ে যাবেন। এরফলে বাস মালিকরা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। তারা সবসময়ই চান, যাত্রীরা ট্রেন বাদ দিয়ে বাসে চলাচল করুক। যেন তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেন।

সরকারের এত বড় একটি খাতকে যদি আমরা লোকসান ও দুর্নীতির কলঙ্ক দিয়ে বিপথে ঠেলে দেই, তাহলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। এতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হলেও সেই উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে না। উন্নয়নকে উন্নয়নের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে আমাকে বা আপনাকে সঠিক সময়ে অফিসে গিয়ে সঠিক কাজটা করতে হবে। এখন আমি বা আপনি যদি সঠিক সময়ে অফিসে গিয়ে সঠিকভাবে কাজটাই না করতে পারি, তাহলে যতই আমরা ডামাঢোল পিটিয়ে উন্নয়নের গল্প বলি না কেন, সেই উন্নয়ন বাস্তবিকভাবে দৃশ্যমান হবে না। তাই প্রশাসনের উচিত, রেলখাতকে সঠিক পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে এগিয়ে নেওয়া। যেন সবাই এই খাতের ওপর ভরসা করতে পারে এবং সঠিকভাবে দুর্ঘটনাবিহীন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

benoydutta.writer@gmail.com