১৯৭১ সালে ভারতে বক্স অফিসে একটি ছবি সবচেয়ে বেশি হিট করেছিল। ছবিটি সমালোচকদের দ্বারাও অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল। ছবিটার নাম ছিল ‘হাতি মেরা সাথি’। দক্ষিণ ভারতীয় প্রয়োজকদের দ্বারা তৈরি এটা ছিল জনপ্রিয় ও সবচেয়ে বড় হিট হিন্দি ছবি। স্যান্ডো এমএমএ চিন্নাপা থেভার সিনেমার গল্পটি লিখেছিলেন। গল্পটি ছিল এতিম রাজু আর চারটি হাতিকে নিয়ে। রাজুকে বেঁচে থাকার জন্য চারটি হাতিকে নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অভিনয় করতে হয়। আস্তে আস্তে সে একটি চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলে। যার নাম থাকে ভালবাসার পৃথিবী। ‘পেয়ার কি দুনিয়া’। সেখানে সেই চারটি হাতির সাথে বাঘ, সিংহ, ভালুক ইত্যাদিও থাকে। এক পর্যায়ে রাজু বিয়েও করে তনু নামের মেয়েকে। তনু তার সন্তানের ক্ষতি হবার ভয়ে রাজুকে হাতি না হয় পরিবার, যে কোনও একটি বেছে নিতে বলে। রাজু স্ত্রী ও সন্তানদের ছেড়ে আজীবনের বন্ধুকে হাতিকে বেছে নেয়। সেই চারটি হাতির একটির নাম ছিল রামু। সেই রামু তখন তাদের সংসার একত্রিত করার দায়িত্ব নেয়। খলনায়ক থেকে রাজুর পরিবারকে বাঁচাতে রামু জীবন উৎসর্গ করে। একটি হাতি তার মনিবের পরিবার বাঁচাতে জীবন উৎসর্গ করে যে পরিবার আলাদা হয়ে গিয়েছিল তার কারণে।
মানুষের জীবনে হাতির এমন অবস্থান দর্শকদের বিস্মিত করে। তাদের জীবনে হাতির এমন গুরুত্ব তারা নতুন করে আবিষ্কার করে।
হাতি। বেশ পরিচিত প্রাণীর নাম। হাতি আর মানুষরে সহাবস্থান আজকের নয়। প্রাচীনকাল থেকে হাতির সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে মানুষের। কিন্তু দিন দিন মানুষ নতুন সখ্যতার দিশা পেয়ে ক্রমশ বন, বন্যপ্রানী, হাতি থেকে দূরে সরে আসছে। মানুষ তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলেছে। মানুষ আর হাতির সম্পর্ক এখন আর পবিত্রতার মধ্যে নেই। এটি ক্রমে হয়ে উঠেছে দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের।
১৯৮০ সালে প্রথম হাতি জরিপ হয়। তখন হাতির সংখ্যা ছিল ৩৮০টি। ২০০০ সালে এসে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৯টি। ২০১৬ সালে সর্বশেষ হাতি জরিপ করা হয়। এ সময় এর সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ২৬৮টি। ২০২১ সালে দেওয়া আইইউসিএনর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ১৭ বছরে ৯০টি হাতি হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে হত্যা করা হয় ১১টি হাতি। কোনোভাবেই এই হত্যা কমানো যাচ্ছে না। বন বিভাগের তথ্য মতে ২০০৪ সাল থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত হাতি হত্যা করা হয়েছে ১১৮টি।
আরেকটি তথ্য অনুযায়ী হাতি মানব দ্বন্দ্বে ২৩৬ জন মানুষ মারা গেছে। আইইউসিএন এর তথ্য অনুয়ায়ী বাংলাদেশে তিন ধরনের হাতি দেখা যায়। কিছু হাতি তাদের আবাসস্থলে বাস করে। কিছু হাতি পরিব্রাজন করে। কিছু হাতি পোষ মানা। বন্য হাতি যারা তারা তাদের আবাসস্থলে বাস করে, তাদের সংখ্যা ২৬৮। পরিব্রাজনকারী হাতির সংখ্যা ৯৩। পোষ মানা হাতির সংখ্যা ৯৬। বিজ্ঞানীদের মতে বাংলাদেশে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ৫০০ এর মতো হাতি ছিল। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী এই হাতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৮ থেকে ৩২৭ এ।
২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ২৬৩টি, যার ৫৫ ভাগই কক্সবাজার এলাকার। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার ছাড়াও মানব হাতি সংষর্ষের ঘটনা ঘটে শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায়।
ডাব্লিউ-ডাব্লিউএফ (WWF) এবং ইউএন (UN) এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের প্রতিবেদন অনুযায়ী মানুষ-বন্যপ্রাণী দ্বন্দ্ব পৃথিবীর অনেক প্রজাতির টিকে থাকার জন্য এখন হুমকিস্বরূপ। একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী এসবের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে বন্য বিড়াল প্রজাতির ওপর। এদের ওপর প্রভাব ৭৫ শতাংশ এরও বেশি। এছাড়া সামুদ্রিক মাংসাশী প্রাণী এবং হাতির ওপরও এসবের ক্ষতিকারক প্রভাব বেশ দেখা যাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১২ টি হাতি চলাচলের জায়গা রয়েছে। কিন্তু এই রাস্তাগুলো হাতি চলাচলের উপযুক্ত না। হাতি বেঁচে থাকার জন্য এই পরিব্রাজনের রাস্তাগুলো খুবই গুরত্বপূর্ণ। কিন্তু দিন দিন এসব জায়গা সংকুচিত হচ্ছে।
সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান শেরপুরে আসেন। শেরপুর জেলা। যেখানে গারো পাহাড় রয়েছে। যেখানে মান্দি, হাজং, হদি, বানাইসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে বাঙালিদেরও বসবাস। যেখানে হাতি-মানব সংঘর্ষের সংবাদ প্রায়ই শোনা যায়। শোনা যায় হাতি হত্যার খবরও। সেখানে এসে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই সপ্তাহেই ১২টি হাতি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এই সমস্যাটি অবহেলিত হতে হতে এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যার একমাত্র সমাধান হাতি-মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। হাতি-মানব সংঘর্ষ নিরসনের জন্য হাতি অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে চান তিনি।
হাতি অভয়ারণ্য। অভয়ারণ্য। অভয়ারণ্য জিনিসটা কি? তাও আবার হাতির। হাতি অভয়ারণ্য কি মানব-হাতি দ্বন্দ্ব থামাতে পারে? অভয়ারণ্য হলো এমন একটি বনাঞ্চল যেখানে বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করা হয়। প্রজনন ও আবাস নিরাপদ করার পাশাপাশি শিকারি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে ২৫টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রয়েছে। এরমধ্যে সামুদ্রিক ডলফিন বা শুশুকের জন্য একটি অভয়ারণ্য রয়েছে। আলাদা করে শুধু হাতির জন্য বাংলাদেশে কোনও অভয়ারণ্য নেই। বিশ্বে শুধু হাতির জন্য এমন কিছু নাম করা অভয়ারণ্য রয়েছে। যেমন, ফুকেট অভয়ারণ্য। এটি থাইল্যান্ডে। এখানে হাতিরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। স্নান করে। থাইল্যান্ডে এরকম আরও হাতি অভয়ারণ্য রয়েছে। যেমন, ফাঙ্গান, এলিফ্যান্ট নেচার পার্ক ইত্যাদি। কম্বোডিয়ায় রয়েছে। যেমন, এলিফ্যান্ট ভ্যালি প্রজেক্ট। কুলেন এলিফ্যান্ট ফরেস্ট ইত্যাদি। এরকম অভয়ারণ্য হয়তো বা হাতি-মানব সংঘাত কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে। কেননা তখন হাতিগুলো পর্যাপ্ত খাবার আর ঘুরে বড়োনোর জায়গা পাবে। আর যে সমস্ত মানুষ হাতি হত্যার সাথে জড়িত, তারাও তা করতে পারবে না অভয়ারণ্যের স্বার্থেই।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক