একজন সহকর্মীর গাড়িকে বাস পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে থেঁতলে দিলো। বাস আটকানো গেলো কোনোমতে। বাসের চালকও পালাতে পারলেন না। বলা হলো মালিককে খবর দিন। তারা বললেন, সমস্যা নাই লোক আসবে। এলো লোক। তারা পুরান ঢাকার ছাত্রলীগ কর্মী বলে পরিচয় দিলেন। বললেন–বাস যখন রাস্তায় চলে তখন আমাদের। মালিক আমাদের দিয়ে রেখেছে। মিরপুর থেকে সদরঘাট,পথে পথে আমাদের এলাকাভিত্তিক সংগঠন বাসের নিরাপত্তা দেয়। যোগাযোগ করা হলো থানার সঙ্গে। তারাও জানালো এলাকাভিত্তিক দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। অবশেষে তাদের বড় ভাইদের সহায়তা নিয়ে যেতে হলো সমাধানের পথে।
একজন সহকর্মীকে ট্রাস্ট কোম্পানির বাসের ড্রাইভার হেলপার পেটালো। ট্রাফিক পুলিশ ও কোম্পানির সুপারভাইজারদের সহায়তায় বাস চলে গেলো নিরাপদ গ্যারেজে। সহকর্মীর দুঃসাহসিকতা এবং পথচারীরা মিলে ড্রাইভারকে আটকে ফেলতে পারলো। ডাকা হলো বাসের মালিককে,তিনি পাত্তা দিলেন না। সড়ক পরিবহনের সর্বোচ্চ নেতা ফোন দিলেন, তাকেও তিনি আমলে নিলেন না। কারণ বাসের পেছনে লেখা—সাবেক আর্মি অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত। বাসের পেছনের লেখাটির জোরেই তিনি কোনও কিছু পরোয়া করছিলেন না। মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর থানার ওসির ধমকে তিনি আসতে রাজি হলেন। তার আগে কোম্পানির সড়ক ব্যবস্থাপকরা এসে টাকার প্রস্তাব দিয়ে বলেন—হাসপাতালে কত খরচ হলো বলেন, দিয়ে দেই। ব্যাপারটা এমন, মানুষ মেরে ফেললেও টাকাতেই সব ঠান্ডা করে দিতে ওস্তাদ তারা। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছ থেকেই শোনা—একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার গাড়িকেও গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এই কোম্পানির বাস। ওই দুর্ঘটনায় একজন সিএনজি যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। তারপরও তারা এতটাই বেপরোয়া।
ওপরের অভিজ্ঞতাগুলোতে এক চিলতে ক্ষমতার দাপট প্রকাশ হলো মাত্র। সড়কে যারা কোম্পানির ছায়ায় বা ব্যক্তিগতভাবে পরিবহন নামায়, তাদের একটি গোষ্ঠী আছে। এই গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সুতোর। ধারালো ‘মাঞ্জা’ দেওয়া সেই সুতোতে সাধারণ পথচারী, যাত্রীদের শুধু রক্তক্ষরণই হয়। তাদের বেপরোয়া গতি, গুন্ডামি প্রশ্রয় পায়। দায় এসে চাপে যাত্রী, পথচারীদের ওপর। অসচেতন মানুষগুলো যেন নিজ থেকে গিয়ে গাড়ির নিচে আত্মাহুতি দিচ্ছি। অসচেতনতা আছে সাধারণ পথচারী, যাত্রীদের সেই কথা কেউ কখনও অস্বীকার করেনি। কিন্তু কিশোরকে বাস, লেগুনার আসনে বসালো কারা? মেয়াদ উত্তীর্ণ পরিবহন সড়কে, মহাসড়কে চলছে কাদের প্রশ্রয়ে, রাজধানীতে বাস রুট বা ফ্র্যাঞ্চাইজে বাস কোম্পানির বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না কাদের চোখ রাঙানিতে? সড়ক নিরাপত্তায় সরকার আইন তৈরি করে তার বাস্তবায়ন করতে গেলে কাদের পরামর্শে পরিবহন চালক, শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় বিশ্রামে চলে যায়?
শহীদ রমিজ উদ্দীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে পিষে মেরেছিল জাবালে নূর। তার প্রতিবাদে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রে সেই আন্দোলনে কালিমা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তারপরও সরকার সড়ক নিরাপদ করার জন্য একটি আইন তৈরি করেছিল,একবছর পেরিয়ে গিয়ে যখন সেই আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হলো, বলা হলো এবার আর কোনও আপস নয়, তখন আবার সারাদেশের মানুষকে জিম্মি করে বসে পরিবহন মালিক, চালক, শ্রমিকেরা। পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রীবাহী পরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশজুড়ে নৈরাজ্য তৈরি করলো তারা। অতীতের মতো এবারও যাত্রী, চালকদের মুখে পোড়া পেট্রোল মেখে দিচ্ছে। সাবেক দু’জন মন্ত্রী তাদের পক্ষে সাফাই আগেও গেয়েছেন, এখনও গাইছেন। প্রসারিত হাসিতে তারা এখনও বলে যাচ্ছেন—জরিমানা ও শাস্তির খড়্গ নিয়ে কীভাবে চালকরা পথে নামবে। হেলপার কীভাবে অষ্টম শ্রেণি পাসের সার্টিফিকেট পাবে। তাদের সেই সাফাই বচনে ধীরে ধীরে দেখা গেলো পরিবহন নেতাদের সঙ্গে সরকারের আলোচনাতেও কুয়াশা ঝরতে লাগলো। তারা ছাড় দিতে শুরু করলেন। বলা হলো—আইন প্রয়োগে বাড়াবাড়ি হবে না। জনগণ জানে গণপরিবহন ছাড় পেলেও সাধারণ মানুষকে ‘বাধ্যতামূলক’ মামলার পরিসংখ্যান পূরণের বলি হতেই হবে। সেখানে কোনও ছাড় নেই। বাড়াবাড়ি চলবেই। তবে সকলের তরেই একটা কথা বলে রাখা বা স্মরণ করিয়ে দেওয়া মঙ্গল মনে করি। যে কাজটি ঢাকার পুলিশ কমিশনারও করেছেন—‘আমাদের সন্তানরা আবারও রাস্তায় নামলে কারও পিঠের চামড়া থাকবে না। সেটা আমি পুলিশ কমিশনারই হই কিংবা পরিবহন মালিক সমিতির বড় নেতাই হোক।’
তবে সড়কের কালসাপ মারতে আমরা সন্তানদের পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে আনতে চাই না। আইনের মোহনবাঁশিতে ঝাঁপিতে আসুক কালসাপ।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি