৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, শুক্রবার। কলকাতার বিশাল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড দুপুর থেকেই কানায় কানায় ভর্তি। বেলা তিনটা নাগাদ কয়েক লাখ মানুষের পদভারে প্রকম্পিত ব্রিগেড। যেমন এসেছেন ভারতীয়রা, ঠিক একইভাবে এসেছেন বাংলাদেশের শরণার্থীরা। আজ এই ব্রিগেডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভাষণ দেবেন। শোনাবেন ভারতের জনগণকে বাংলাদেশ সম্পর্কে তার চিন্তাধারার কথা। বিকাল চারটা নাগাদ এলেন ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী। বক্তৃতার শুরুতেই জানালেন বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবির প্রতি তার দেশের জনগণের ও সরকারের সমর্থনের কথা। কয়েক মিনিট বক্তৃতা দিতেই হঠাৎ তার এক ব্যক্তিগত স্টাফ এসে তার হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিলেন। কয়েক সেকেন্ডে চিরকুটটা পড়ে তার বক্তৃতা শেষ করে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন মঞ্চ হতে। সমবেত জনতার মনে বড় প্রশ্ন, কেন তিনি এমন তাড়াতাড়ি তার বক্তৃতা থামিয়ে মাঝপথে মঞ্চ ছাড়লেন? ব্রিগেড হতে রাজভবন খুব বেশি দূরে নয়। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল এন্থনি ল্যান্সলট ডায়াজ। সেখানে পৌঁছাতে ইন্দিরা গান্ধির বেশি সময় লাগলো না। সরাসরি দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ পেলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ভারতের পশ্চিম সীমান্তের অগ্রভাগের বেশকিছু বিমান ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। যার মধ্যে আছে অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর ও আগ্রা। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এই খবর দিতে ব্যর্থ হয়েছিল যে, এসব বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর কোনও বিমান নাই। সেগুলো আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
রাজভবন হতে ইন্দিরা গান্ধী সরাসরি দমদম বিমানবন্দরে। সেখান হতে একটি বিশেষ সামরিক বিমানে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা। তাকে নিরাপত্তা দিতে আকাশে উড়লো আরও কয়েকটি জঙ্গি বিমান। ইন্দিরা গান্ধীর বিমান আকাশে ওড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশবাণী ঘোষণা করলো কিছু সময় পর একটি বিশেষ ঘোষণা দেওয়া হবে। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের দৃষ্টি তখন সেই ঘোষণার দিকে। কী ঘোষণা হবে ভারতীয় বেতারে? ভারত বাংলাদেশে টানটান উত্তেজনা। সেকেন্ডকে মনে হচ্ছে মিনিট আর মিনিটকে ঘণ্টা। বিমানে বসেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার একটা সংক্ষিপ্ত ভাষণের খসড়া তৈরি করলেন। ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি পৌঁছে গেছেন। দিল্লিতে তখন ব্ল্যাকআউট কার্যকর করা হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে বৈঠক করলেন তার দেশের বিভিন্নবাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে। পরে মন্ত্রিপরিষদের সভা। দিল্লির সময় সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টা। বসলো লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত সদস্যদের জানালেন সব ঘটনা। বললেন, ‘আমরা অন্যদেশ আক্রমণ করে তা দখল করতে চাই না। আমরা চেষ্টা করেছি পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে, কিন্তু পারিনি। আক্রান্ত হলে নিজেদের রক্ষা করতে জানি। পাকিস্তানের হামলা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শামিল।’ তিনি এও বললেন, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চান। এরই মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি তার নিজ দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পূর্বে রেকর্ড হওয়া ভাষণটি (যা তিনি বিমানে খসড়া করেছিলেন) ভারতের সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে বাজানো হয়। তিনি তার ভাষণ শেষ করেন এই বলে—‘We are at war’ (আমরা এখন যুদ্ধে)।
সন্ধ্যা নামার আগেই আমাদের সরকার সংবাদ পেয়ে গেছে নতুন সূর্যোদয় দেখার সময় হয়ে এসেছে। সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর নয়জন বেসামরিক বাঙালি পাইলট ও আটান্নজন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এক সময়ের পাইলট চিন্তা করলো মুক্তিবাহিনীর একটি বিমানবাহিনী থাকা চাই। ভারত সরকার রাজি হলো তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে। তারা একটি বিমানবাহিনী কমান্ড তৈরি করলো গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারের নেতৃত্বে। দেওয়া হলো দুটি বিমান ও একটি হেলিকপ্টার। এর কোনোটাই ঠিক যুদ্ধবিমান নয়। আমাদের বৈমানিকরা এই বিমান ও হেলিকপ্টারকে যুদ্ধবিমানে রূপান্তর করলেন। এই বিমান দিয়েই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চূড়ান্ত লড়াই শুরু করে ৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর। অপারেশনের নেতৃত্বে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ। তারা কয়েকটি রকেট নিয়ে উড়াল দিলো তাদের প্রশিক্ষণ স্থান নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর হতে। তখন বাংলাদেশের শীতের আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। তাদের টার্গেট চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো। যুদ্ধ করতে যানবাহন ট্যাংক বিমান বহরে তেল লাগে। তার উৎস ধ্বংস করতে হবে। আমাদের বিমান যোদ্ধারা সব বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে খুব নিচ দিয়ে। শত্রুপক্ষের রাডারকে ফাঁকি দিতে হবে। কুয়াশা ভেদ করে তারা কর্ণফুলী নদীর ওপর জাহাজের বাতি দেখতে পায়। সেখান হতে চট্টগ্রাম রিফাইনারি এলাকা। তারপর বাকিটা ইতিহাস। বিশ্বের একমাত্র গেরিলাবাহিনী যাদের নিজস্ব বিমানবাহিনী আছে। এর আগে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ন্যাভেল কমান্ডো চট্টগ্রাম বন্দরে আঘাত হেনে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। সেই অপারেশন ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। বিশ্বের মানুষ বাঙালি মুক্তিবাহিনী শৌর্যবীর্যের কীর্তি অবাক বিস্ময়ে দেখলো। নারায়ণগঞ্জ বা গোদনাইল খুঁজে পেতে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি। ঢাকা বঙ্গভবনসহ অনেক সাদা ভবন আছে। রাতের আঁধারে দেখা যায়।
চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের মানুষ খুব ভোরে দেখে তাদের আকাশ কালো ধোঁয়ায় ভরা। দুই শহরেই তেলের ডিপোগুলো জ্বলছে। ভোর ছয়টার বিবিসি’র বাংলা খবরে ঘোষণা করা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতের সেনাবাহিনী একটি যৌথ কমান্ডের অধীনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের চূড়ান্ত লড়াই শুরু করে দিয়েছে। আর সেই লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। আজকের প্রজন্ম কি জানে তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একাত্তরে আমরা যুদ্ধে গিয়েছিলাম। বাংলা ও বাঙালির জয় হোক।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক