আমার নজর কাউন্সিলর প্রার্থীর দিকে

তুষার আবদুল্লাহসবাই তাকিয়ে মেয়র প্রার্থীদের দিকে। কাউন্সিলর প্রার্থীর দিকে আমার চোখ। কারণ নাগরিক হিসেবে আমার প্রাথমিক সেবা উপভোগের শুরু নিজ বাসস্থান থেকে। বাড়িতে আমি মশকমুক্ত থাকতে পারছি কিনা, মহল্লার সড়ক ও নর্দমা পরিচ্ছন্ন রাখা, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত এলাকা, খেলার মাঠ, পার্ক, বাজার ও সড়ক বাতির মাধ্যমে আমি কতটা নাগরিক সেবা পাবো, তা নিশ্চিত করবেন আমার ওয়ার্ড কাউন্সিলর। জন্মনিবন্ধনসহ যেকোনও প্রয়োজনে তিনি কতটা সহজলভ্য হবেন, এটিও আমাকে ভাবাচ্ছে। সিটি করপোরেশনের সব ওয়ার্ড নিয়ে উন্নয়নের ইশতেহার তৈরি করছেন মেয়রপ্রার্থী। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পুরো নগরের সেবা ও সৌন্দর্যের ভারসাম্য রক্ষা করবেন তিনি। মেয়র উন্নয়নের যে পথচিত্র তৈরি করবেন, সেই চিত্রের প্রথম আঁচড়টি আসবে ওয়ার্ড থেকে। কাউন্সিলর তার এলাকার নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে উন্নয়নের তাৎক্ষণিক, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদের লক্ষ্য স্থির করবেন। স্বাভাবিকভাবে একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে নগরের বাসিন্দারা এমনভাবেই সক্রিয় দেখতে চান। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ভোটের ফল ঘোষণার পর মুহূর্ত থেকে কাউন্সিলরদের দলীয় পরিখার বাইরে বের হতে দেখা যায় না। এলাকায়ই তারা আকাশের চাঁদ হয়ে ওঠেন। জন্মনিবন্ধন বা নাগরিক সনদের জন্যও নাগরিকরা কাউন্সিলরের চৌকাঠ পেরোতে পারেন না।

এলাকায় সন্ত্রাস, কিশোর গ্যাং, মাদকের মতো ঘটনা যতই বাড়ুক, কাউন্সিলরকে মাঠে দেখতে পান না নাগরিকরা। বরং এলাকায় ভয়ের উত্তাপ ছড়িয়ে রাখেন যারা, তাদের পেছনের জ্বালানি হিসেবে থাকেন কোনও কোনও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিজেই। কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে মাদক, ক্যাসিনোর মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ারও অভিযোগ আছে। ফুটপাত দখল করে হকার বসানো, পরোক্ষ, প্রত্যক্ষ চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগের ফর্দও কম ছোট নয়। কোনও কোনও কাউন্সিলর ওয়ার্ডে তো থাকেনই না, এমনকি দেশেও তাদের অবস্থান স্বল্প সময়ের জন্য। তাই স্থানীয় দুর্যোগ, জাতীয় দুর্যোগেও তাদের মাঠে দেখা যায় না। ডেঙ্গু দুর্যোগ মোকাবিলা করতে নগরবাসী কয়জন কাউন্সিলরকে পাশে পেয়েছেন। নগরবাসীর চেয়ে দুর্ভাগা মেয়র। কারণ তাদের পাশেও দুই-একজন ছাড়া বাকি কাউন্সিলরদের দেখা যায়নি। যাদের দেখা গেছে, তারা নগর রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন বলেই মেয়রের পাশে বা পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

কাউন্সিলররা কেন নিষ্ক্রিয় থাকেন? যতদূর মনে পড়ে ১৯৯৪ সালে অবিভক্ত সিটি করপোরেশনে প্রথমবার যারা নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন কমিশনার হিসেবে, তারা তো নিষ্ক্রিয় বা জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। নাগরিকদের কাছে তারা সহজলভ্য ছিলেন। সন্ত্রাস বা এলাকায় নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ থেকে মুক্ত না থাকলেও জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন না। আপদে বিপদে নাগরিকরা তাদের পাশে কাউন্সিলরদের দেখতে পেতেন। রাজনৈতিক দৃশ্যায়ন হলেও ব্যাপারটা মন্দ ছিল না। ধীরে ধীরে তারা মাঠ থেকে হারিয়ে যেতে থাকেন। কাউন্সিলরদের একটি অংশ জাতীয় রাজনীতিমুখী হন, আরেকটি বড় অংশ ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। আরেকটি বড় ঘটনাও ঘটলো পাশাপাশি, মেয়র হয়ে যারা আসতে থাকলেন, তারা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর লোভে ডুবে গেলেন। নগর উন্নয়ন, পরিচর্যা যে একটি দলগত বিষয়, তারা ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে গেলেন। ডেঙ্গু সচেতনতা এবং পরিচ্ছন্ন অভিযানে তাই নিজেরাই ঝাড়ু, ফগার মেশিন নিয়ে নামলেন, সঙ্গে কাউন্সিলরদের বদলে তারকাদের দেখা গেলো। নাগরিকেরা গলিপথ, রাজপথ ঘুরে কাউন্সিলরদের দেখা পেলেন না। কাউন্সিলরদের দিক থেকে অভিযোগ শোনা গেলো—তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের নানা আইনি ধারা দিয়ে।

রাজধানীর দুই প্রান্তে আবার ভোট এসেছে। পলিথিন মোড়ানো পোস্টার শোভা পাচ্ছে। মহল্লার আকাশে ঝুলিয়ে রাখা পোস্টারের বেশিরভাগই কাউন্সিলর প্রার্থীদের। দৃশ্যমাধ্যমে সুযোগ না পেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং পত্রিকায় তাদের প্রতিশ্রুতি অল্প হলেও শোনা যাচ্ছে। তারা এলাকার উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের এসব প্রতিশ্রুতি এবং উন্নয়ন ইচ্ছাকে পলিথিন দিয়ে জলে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচানো যাবে না, যদি না তারা নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে নগর পরিচর্যা ও উন্নয়নের নকশা তৈরি করেন। আগামীতে যারা মেয়র হয়ে আসবেন, তারা যদি সেই একক নৈপুণ্য প্রদর্শনেই ঝাঁপ দেন, তবে নগর নিয়ে মেয়ররা যে চটকদার বা লোভনীয় স্লোগান দিচ্ছেন, সেটা ভোটের পরদিন সকাল থেকেই দীর্ঘশ্বাসে জলে ভেসে যাবে। তাই ভোটের লড়াইয়ে শুধু মেয়রের দিকে নয়, আলো ফেলা দরকার কাউন্সিলরের ওপরও। একটি কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, নগর নির্বাচনকে উৎসবের রঙ দেন এই কাউন্সিলর প্রার্থীরাই।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি