চীন থেকে শুরু হয়েছিল এই জৈবকণাটির আস্ফালন। এখন তার দাপুটে অবস্থান ইউরোপে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, উত্তর আমেরিকাও কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পায়নি। বিশেষ করে ইরান, ইতালি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে এখানে। চীন অনেকটা সামলে উঠলেও ইতালি, স্পেন, লন্ডন, আমেরিকা এখন চরম ঝুঁকিতে আছে। নিত্য বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। বাংলাদেশ কোভিড-১৯ থেকে কি নিরাপদে আছে, দেশের পর দেশ যখন এই মহামারিতে স্থানীয়ভাবে জরুরি অবস্থা জারি করছে, তখন বাংলাদেশ কি সত্যিই নিরাপদ? ব্যক্তিগতভাবে আমি জৈবকণা বা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নই। তবে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমাদের সঙ্গে নানা দফতরের কর্তা এবং বিশেষজ্ঞদের কথোপকথনের সুযোগ আছে। কোভিড-১৯ চীনে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করার পর থেকে এই কথোপকথন চলছে। তাতে যতটুকু বুঝতে পারছি, সাধারণভাবে আমাদের ঝুঁকি অনেকটা কম ছিল। কারণ ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, নেপাল, ইতালির মতো আমরা পর্যটন প্রধান দেশ নই। তাই পর্যটকদের মাধ্যমে আমাদের এখানে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। শুধু বিমানবন্দরে যদি সুরক্ষা ব্যবস্থা মজবুত করা যায়, তবেই আমরা অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারি। কিন্তু দেখা গেলো বিমানবন্দর বা দেশের প্রবেশদ্বারে আমরা একেবারেই হালকা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। নিরীক্ষা যন্ত্র নষ্ট ছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষা যথাযথভাবে হয়নি। ফল চীনের উহান থেকে ফেরা যাত্রীদের মাধ্যমে নয়, কোভিড-১৯ এর প্রবেশ ঘটলো ইতালিফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে। ইতালিতে থাকা প্রবাসীদের একটি দল আজো ফিরলো। তাদের কতটা নিপুণভাবে নিরীক্ষা করা হবে বুঝতে পারছি না। সরকারের পক্ষ থেকে একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ যাত্রা নিরুৎসাহিত করা হলেও, অনেকে সেটা কানে তোলেননি। প্রবাসে থাকা বাংলাদেশিদের দেশে ফিরে আসতে না করা হচ্ছে, তবুও তারা ফিরছেন। এখানে তাদের গৃহ বিচ্ছিন্নতা বা নির্বাসন কতটা নিয়মমতো হচ্ছে, এনিয়ে সংশয় থেকে যায়।
সব দেশ যেভাবে নিজেদের স্বেচ্ছা বন্দি করে ফেলছে, একইভাবে কি আমরা পারবো? আমাদের পরিবার ও সামজিক আচার-আচরণ কতটা এজন্য সহায়ক। বাড়িতে স্বেচ্ছা বন্দিত্বে ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, বাবা-মায়ের কাছ থেকে কতটা আলাদা থাকতে পারি আমি? আমাদের কয়টি পরিবার একাধিক শোবার ঘরের সক্ষমতা রাখে? পরিবারের রোজগারের জন্য বাইরে বের হওয়ার অত্যাবশ্যকতাকে কতটি পরিবার এড়িয়ে যেতে পারি? সেই সঙ্গে সামাজিকভাবে একঘরে বা বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ভীতিও আছে। চাকরির নিরাপত্তার দিকটিও ভাবতে হয়। তাই সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের কিছু মানুষ হয়তো স্বেচ্ছা বন্দি জীবন বেছে নিতে পারবেন, বাকিদের সেই সক্ষমতা বা সুযোগ নেই। এই সুযোগটি তৈরি করে দিতে হবে সমাজ এবং রাষ্ট্রের। এলাকাভিত্তিক সংগঠনগুলো স্কুল, কলেজ, মিলনায়তনকে কোয়ারেন্টাইন বা বিচ্ছিন্ন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে পারে। এই কাজে স্থানীয় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে। সেবিকা, চিকিৎসক, খাবার এবং ওষুধের জোগানদাতা হতে হবে প্রশাসনকে। বিদেশ থেকে কেউ ফিরলে পরিবারের কাজ হবে ওই বিচ্ছিন্ন কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তথ্য লুকালে শুধু ওই পরিবারটি নয়, পুরো দেশ বিপদে পড়বে, এই উপলব্ধি জাগতে হবে আমাদের সকলের মাঝে।
সংগঠনগুলোকে উদ্যোগী হতে বলার কারণ—কোভিড-১৯কে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ লোকের মুখে মুখে নানা গুজব ও টোটকা চিকিৎসা ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা সাধারণ মানুষের মধ্যে অকারণ আতঙ্কও তৈরি করছে। এর প্রভাব গড়াচ্ছে বাজার পর্যন্ত। সংগঠনগুলো সক্রিয় হলে কোথাও পণ্য বেশি দামে বিক্রি করলে যেমন তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে তেমনি সম্ভব হবে গুজবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। মনে রাখতে হবে এই মুকুট যুক্ত জৈবকণাকে রাষ্ট্র একা রুখতে পারবে না। তাকে রুখতে হবে সম্মিলিতভাবে।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি