বিচ্ছিন্নতায় সৃষ্টি হোক মানবতার ঐক্য

প্রভাষ আমিনবাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, ঢাকাও সবচেয়ে জনবহুল শহরের তালিকায় ওপরের দিকেই থাকে। আমার ধারণা, কাওরানবাজারে প্রতিদিন যত লোক আসে, পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা তারচেয়ে অনেক কম। যে কোনও উৎসবে-পার্বণে লাখো মানুষের ঢল নামে রাস্তায়। রাজনৈতিক জনসভা, স্টেডিয়াম, কনসার্ট, ওয়াজ, যাত্রা সর্বত্রই গিজগিজ করে মানুষ। ফার্মগেট, গুলিস্তান বা কাওরানবাজারে কোনও একজন অঙ্গভঙ্গি করলেই কয়েকশ’ লোক জড়ো হয়ে যান। আর আমরা সবসময় আড্ডা মেরে, ছুটির সময়টা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করি। আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোন; বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসে আমাদের অসামাজিক করে তোলে। আমরা অ্যাকচুয়াল বন্ধুদের ভুলে ভার্চুয়াল বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওই যে বললাম, ‘চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো ভাইবোন; বন্ধু-বান্ধব’; এখনও সবাই একত্রিত হয়। কিন্তু কেউ কারও দিকে তাকায় না, সবাই ব্যস্ত থাকে স্মার্ট ডিভাইসে। পাশের রুমে অসুস্থ মা শুয়ে আছেন, সে খবর নেই। ফেসবুকে মা দিবস নিয়ে বিশাল আবেগঘন স্ট্যাটাস হাজির। ফেসবুকে নাকি ইদানীং প্রেমও হয়ে যায়। কীভাবে? আমি জানি না। এক পলকের একটু দেখার যে ভালোলাগা, এতটুকু ছোঁয়ার যে শিহরণ; তা কি মেলে ভার্চুয়াল প্রেমে। অনেকে প্রেমিক-প্রেমিকার এতটুকু ছোয়ার শিহরণ নিয়ে পার করে দিতে পারে গোটা জীবন। প্রযুক্তি বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করেছে। কিন্তু মানুষকে করেছে বিচ্ছিন্ন। করোনা এসে সেই বিচ্ছিন্নতাকেই নিয়ম বানিয়ে ফেললো যেন। দেশ থেকে দেশ, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি বিচ্ছিন্নতাই করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর সবচেয়ে বড় উপায়। কিন্তু গোটা বিশ্ব এখন একটি গ্রাম। তাই এই গ্রামের এক পাড়া থেকে আরেক পাড়াকে বিচ্ছিন্ন রাখা কঠিন শুধু নয়, প্রায় অসম্ভব। তবুও বিভিন্ন দেশ চেষ্টা করছে।

উন্নত দেশগুলো নানাভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশে বিষয়টা জটিল। বাংলাদেশে মানুষ বেশি। নিম্নবিত্তের মানুষেরা বস্তি এলাকায় সংঘবদ্ধভাবে থাকেন। তাই তাদের পক্ষে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব নয়। আগে শুনতাম সমবেত মানুষকে ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাগতো। আর এখন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ঘরে রাখতে সেনাবাহিনী লাগে। আমরা এখনও যেন বিচ্ছিন্নতার গুরুত্বটা বুঝতে পারিনি পুরোপুরি। তাই তো স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়ার পর আমরা দল বেঁধে কক্সবাজার, বান্দরবান নিদেনপক্ষে চিড়িয়াখানায় ভিড় করি। সব বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ এখন। কিন্তু তাই বলে কি মানুষ ঘরে বসে থাকবে? টানা ১০ দিনের ছুটি পেয়ে মানুষ দলে দলে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। অথচ ছুটি দেওয়া হয়েছিল ঘরে থাকার জন্য, বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য। এখন মনে হচ্ছে সেনাবাহিনী নামানোর পরে ছুটির ঘোষণা দেওয়ার দরকার ছিল।

দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা সারাবিশ্বেই প্রশংসিত। ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, শৈত্যপ্রবাহ, ভবনধসে সাধারণ মানুষ দুর্গতদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু এবারই প্রথম বিশ্বজুড়ে এমন এক দুর্যোগ হাজির হয়েছে, ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা মোকাবিলায় সম্ভব নয়। একতাই বল, এই তত্ত্ব এখন বিকল। এখনকার নতুন তত্ত্ব—বিচ্ছিন্নতায় মুক্তি। এমনিতে বাংলাদেশে সামাজিকতা হলো, কেউ অসুস্থ হলে আত্মীয়-স্বজনরা তাকে দেখতে আসেন, তার পাশে দাঁড়ান। কিন্তু এখন মানবতা হলো, কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার কাছ থেকে দূরে থাকা। যদি মনে হয়, আপনি করোনায় আক্রান্ত, আইসোলেশনে চলে যান, নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলুন। এই বিচ্ছিন্নতা আপনার জন্য যেমন দরকার, আপনার স্বজনদের জন্যও দরকার। আপনার কোনও স্বজন করোনা আক্রান্ত হলে ভুলেও তাকে দেখতে যাবেন না। আপনার পরিবারের কেউ হলে তাকে আলাদা রাখুন। করোনা আক্রান্তের বিপদে পাশে থাকতে গিয়ে তাকে এবং নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন না। এই বিচ্ছিন্নতা স্বার্থপরতা নয়, বিচ্ছিন্নতাই এখন মানবতা।

তাই বলে কি বিপদে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে না, মানবতা হারিয়ে যাবে? না। শুধু পাশে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রাখাই মানবতা নয়। করোনা বিপদে এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়াচ্ছে অর্থ নিয়ে, অভিজ্ঞতা নিয়ে। চীন যখন প্রথম আক্রান্ত হয়, তখন অনেকেই চীনের পাশে ছিল। আজ আবার চীন তার সামর্থ্য এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে অন্য দেশের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে বিচ্ছিন্নতা থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে মানবতার ঐক্য। কোনও কোম্পানি হয়তো মাস্ক বিলি করছে, কেউ হয়তো স্যানিটাইজার বিলি করছে। বাজারে যখন স্যানিটাইজারের আকাল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট স্বল্প ব্যয়ে স্যানিটাইজার তৈরি করছে। সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে নিজ নিজ জায়গা থেকেই কাজ করছে। তবে বাংলাদেশে আরও অনেক বড় বড় কোম্পানি ও ব্যাংক আছে, যাদের এখনও এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। তবে সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। আমার ধারণা আসল বিপদটা সামনে। আমরা যেন তৈরি থাকি।

করোনারি বিপদ সামাল দেওয়া গেলেও করোনা অর্থনীতিতে যে ধস নিয়ে আসবে, তা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের অনেকেরই নেই।  বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষদের বিপদ বাড়বে। ইতোমধ্যে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। বড় ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়বেন। তবে তাদের সামাল দেওয়ার সক্ষমতা থাকলেও অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর তা নেই। দিনমজুরদের তো দিন আনি, দিন খাই দশা। বাংলাদেশের ফুটপাত লাখো মানুষের উপার্জনের ক্ষেত্র। সেই ফুটপাত এখন শূন্য প্রায়। ফুটপাতের কর্মজীবীরা এখন বেকার। রিকশায় যাত্রী নেই, শপিং মলে মানুষ নেই। ব্যাবসা-বাণিজ্যে করোনার অভিঘাত সামাল দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের কতটা আছে, সেটা পরে বিচার করা যাবে; কিন্তু স্বল্প আয়ের দিন আনি দিন খাই মানুষগুলোর হাঁড়িতে টান পড়েছে। বিপদের দিনের জন্য তাদের কোনও সঞ্চয় থাকে না, আসলে রাখার সুযোগ থাকে না। সেই মানুষগুলো এখন কী করবে? সবকিছু বন্ধ থাকলে এই মানুষগুলোর কী হবে?

এখানেই আমাদের দায়িত্ব। সামর্থ্যবান যারা আছেন তারা যেন এগিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের জন্য জরুরি অনুদানে বড় আকারের তহবিল গঠন করতে হবে। যাতে নিম্নবিত্তের মানুষদের দীর্ঘমেয়াদে সহায়তা করা যায়। বাংলাদেশের ব্যাংক এবং বড় বড় গ্রুপ তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল থেকে গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে। আর ব্যক্তিগতভাবে আপনি খেয়াল রাখুন, আপনার ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর দায়িত্ব যেন আপনারই থাকে। আপনার বাসার সহকারী, ড্রাইভার, অফিসের পিয়নকে যদি সতর্কতার কারণে ছুটি দিয়ে থাকেন, অবশ্যই তার পাওনা পরিশোধ করে দিন। পারলে কিছু বেশি টাকা দিন। পারলে কিছু খাবার কিনে দিন। করোনার বিপদ কেটে গেলে যেন এই মানুষগুলোকে আবার ফিরে পান, ততদিন যেন তারা টিকে থাকতে পারে; সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কিন্তু আপনার। আর আপনার সহকারীরা যদি কাজে থাকে; তাহলে আপনার পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপত্তার পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিয়ে তার নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতাও নিশ্চিত করুন। এটা আপনার স্বার্থেই করুন। কারণ আপনার ড্রাইভার করোনার ঝুঁকিতে থাকা মানে কিন্তু আপনিও থাকা।

এই বিচ্ছিন্নতার কালে বেশকিছু খবর আমাদের আশাবাদী করে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে মাস্ক বা স্যানিটাইজার বিলি করছেন। বেশ কয়েকজন বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া মওকুফের ঘোষণা দিয়েছেন। আমার আশঙ্কা, করোনার আতঙ্ক কেটে যাওয়ার আসল সঙ্কট শুরু হবে। সেই সময়ের জন্য আমাদের এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে।

করোনা বিচ্ছিন্নতা যেন আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ করে। শারীরিক দূরত্ব যেন আমাদের মানসিকভাবে আরও কাছে টানে। বড় সঙ্কট যেন আমাদের আরও মানবিক করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কল্যাণের পথে যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্ব। করোনা পরিস্থিতির অভিঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই। এই দুর্যোগ যেন আমাদের আরও মানবিক করে তোলে। বারবার প্রকৃতি সভ্যতার পরীক্ষা নেয়। সব পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত মানুষই জয়ী হয়। তাই সভ্যতা এগিয়ে যায়। করোনা পরীক্ষায়ও মানবতারই জয় হবে। বিচ্ছিন্নতা থেকেই সৃষ্টি হোক মানবিকতার ঐক্য।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ