করোনায় তারুণ্য

তুষার আবদুল্লাহচোখ ভিজে গেলো। ছেলেটি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তার কাছে আছে তিনশ’ টাকা। সেই টাকা দিয়ে দিতে চাইলো কভিড-১৯ সংক্রমণের এই সংকটকালে অসহায় মানুষের সেবায়। ছেলেটি বললো—আমি তো ছোট মানুষ, বেশি টাকা নেই। আয় করি না। আয় করতে পারলে আরও টাকা পাঠাতাম। চট্টগ্রামের এই ছেলেটির মতো আরও অনেকে টাকা পাঠাচ্ছে। মুঠোতে থাকা ৫০ টাকা পাঠিয়েছে কতজন। এদের অনেকের পরিচয় জানি না। আগ্রহ নিয়ে ফোন করে কয়েকজনের পরিচয় জানতে পেরেছি, ওরা তরুণ। দেশের নানা প্রান্ত থেকে টাকা পাঠাচ্ছে। শুধু কী টাকা? রাত জেগে তারা এলাকার মানুষের খোঁজ খবর রাখছে। দশ দিনের সাধারণ ছুটি বা অঘোষিত লকডাউন দেওয়ার পর, এই বিচ্ছিন্নতার সময়ে আমরা যখন ভাবছিলাম কীভাবে ঘরে থাকা মানুষদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যায়, তাদের জন্য রক্তের ডোনারের ব্যবস্থা, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেওয়া যায়? তখন ভাবনায় এলো কত তরুণ এখন ঘরে বসে আছে। তারাতো আমাদের জ্বালানি হতে পারে এই দুর্যোগের সময়ে। ঘরে ঘরে এত কমরেড থাকতে চিন্তা কী?
দিনটি ছিল ২৫ মার্চ। কাল রাত। একাত্তরের মতো নিকষ এক কাল রাত। আমাদের তরুণরাতো একাত্তরে এই উত্তাল মার্চেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশ রক্ষায়। ২০২০-এ আবার তো এলো সেই দেশ রক্ষা, দেশের মানুষকে রক্ষার সময়। তাই সময়ের প্রয়োজনে আমরা তরুণদের বললাম—চলো এক হই। মুহূর্তেই সারাদেশ থেকে, পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-ইউনিয়ন থেকে তরুণরা জেগে উঠলো। বলল—মানুষের পাশে ২৪ ঘণ্টা আছে তারা। করোনার সংক্রমণ থেকে মানুষকে রক্ষায়, সংক্রমণের বাইরে থাকা মানুষের সুরক্ষা এবং সেবার প্রহরী তারা।

এই তরুণদের মধ্যে আছেন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা। আছেন তরুণ পেশাজীবীরা। বিশেষ করে চিকিৎসকদের কথা বলতেই হয়। তারা নিজেরাই ২৪ ঘণ্টাকে ভাগ করে পালাক্রমে সেবা দিতে শুরু করেছেন। তরুণ ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধিরা নেমেছেন সর্বস্ব নিয়ে। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, তা নিয়েই নেমেছেন তারা। অবশ্যই স্বীকার করতে হচ্ছে সহকর্মী অর্থাৎ গণমাধ্যমকর্মীদের কথা। তারা তাদের সংবাদ সংগ্রহ কাজের পাশাপাশি, সাধারণ মানুষের সেবায় তৎপর। এটি শুধু ঢাকার সংবাদকর্মীদের কথাই বলছি না। দেশজুড়ে একই চিত্র দেখছি। বয়সের তারুণ্যের কোঠায় যারা আছেন, তাদের বাইরেও তারুণ্য আছে। ৭৩ বছর বয়সী একজন মা ফোন করে বললেন, বাবা ঘরে বসে আছি। আমি তোমাদের কী কাজে আসতে পারি? এই মায়ের মতো অসংখ্য মা আমাদের ফোন করছেন। বাবারাও ফোন করছেন। এদের সকলে কোভিড-১৯ এর ঝুঁকির বয়সসীমার মধ্যে আছেন। কিন্তু মানসিক চিন্তার জায়গা থেকে তারা তরুণ। সমাজ, রাষ্ট্রের এই সংকটকালে তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে রাজি নন।

শৌর্যে, বীর্যে আমরা যেন ফিরে গেছি একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে সমগ্র পূর্ববাংলাতো এভাবেই জেগে উঠেছিল। গোটা বাংলাদেশের বয়স নেমে এসেছিল আঠারতে।

কোভিড-১৯ সংক্রমণে আক্রান্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের স্পষ্ট একটি সামাজিক তফাৎ রয়েছে। আমি জানি না অন্যান্য আক্রান্ত দেশের মানুষেরা একে অপরের পাশে এভাবে এসে দাঁড়িয়েছে কিনা? পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকেরা অনেকাংশে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্র তাদের ঘরে চিকিৎসাসেবা ও খাবার পৌঁছে দেবে, সেই ভরসায় থাকতে হচ্ছে অধিকাংশ দেশের মানুষকে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। শুধু রাষ্ট্রের ভরসায় বসে নেই আমরা। পাশের মানুষটির পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। কাউকে অসহায়, নিঃসঙ্গ ভাবতে দিচ্ছে না। কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে সম্মিলিত উদ্যোগই আমাদের বড় শক্তি। করোনা জয়ে তারুণ্যে যখন রণক্ষেত্রে, তখন আমাদের আতঙ্কিত বা ভয়ের কোনও সুযোগ নেই। করোনায় তারুণ্য আমাদের জয় এনে দেবেই।

লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি