দুনিয়ার প্রায় সব দেশেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটকালে অভ্যন্তরীণ খরচ কমানো বা কৃচ্ছ্রসাধনের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। অনেকটা সক্রেটিসের ‘হাউ মেনি থিংস আই ক্যান ডু উইদাউট’। এতদসংক্রান্ত উদ্যোগ-ইতিহাস বিবেচনায় দেখা যায় প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই তার পরিচালন খরচের প্রায় ১০-২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলতে পেরেছে। তার বেশিরভাগই সরবরাহকারীদের সঙ্গে চরম ‘বারগেইন’ বা দরদামের প্রতিফলন। দুর্দিনে কোম্পানিগুলোর ‘প্রকিউরমেন্ট’ বা ‘সাপ্লাই চেইন’ বা কমার্শিয়াল বিভাগের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। প্রকিউরমেন্ট বা সাপ্লাই চেইন প্ল্যানিং সামনের সারির বিবেচ্য বিষয় বা সিইও কনসার্ন বা প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়ায়।
সংকটকালে সাঁতরে ভেসে থাকতে পারা একটি বিরাট গুণ। ২০০৭-০৯ সংকটকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস এক বিরাট নজির স্থাপন করে। তাদের যখন রুট র্যাশনালাইজেশনের ফলে প্রতিষ্ঠানকে ছোট করে আনার তাগিদের মুখে লোক ছাঁটাইয়ের ব্যাপারটি চলে আসে, তখন তাদের সিইও সকল সহকর্মীকে নিয়ে লোক ছাঁটাইয়ের পরিবর্তে ২০ শতাংশের ওপর বেতন কর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তা সবাই সাদরে মেনে নেয় এবং এতে প্রতিষ্ঠান ও ছোট ছোট চাকরিজীবী উভয়ই বেঁচে যান।
আমাদের দেশেও ইদানীংকালে বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালন ব্যয় দেশি- বিদেশি দক্ষ লোক নিয়োগ ও তাদের প্রণোদনা, সরকারের বা সরকারের নিকটবর্তী লোকজনদের চাঁদা বা ঘুষসহ বিভিন্ন কারণে অনেক বেড়ে গিয়েছে এবং নিট মুনাফা এমনকি অভ্যন্তরীণ ক্যাশ জেনারেশন বা নগদ অর্থায়ন অনেক কমে গেছে। তার ওপরে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে এসেছে করোনা অভিঘাত।
ঋণ রিশিডিউল করা ইতিহাসের কোম্পানিগুলোকে যেমন ভালো ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে চায় না, তেমনি সংকটকাল উত্তরণে ব্যর্থ বা লাগামহীন কোম্পানিগুলোকেও ব্যাংক ভালোবাসে না। তাই বাংলাদেশের ভালো বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোকে সংকটে ভেসে থাকার কৌশল রপ্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন বা ‘জিততে হয় কেনায়’ সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করতে হবে। ‘কস্ট অপটিমাইজেশন’ বা ‘বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং’ও হতে পারে আকাঙ্ক্ষিত পথ। আর এটি শুরু হতে হবে বড়দের দিয়েই। অফিসের টাকায় ব্যক্তিগত খরচ নির্বাহের অভ্যাসকে কবর দিতে হবে। ১ কোটি টাকা খরচের কোম্পানিও যদি ১০ শতাংশ খরচ অভিনব উপায়ে কমাতে পারে, তাহলে ১০ লাখ টাকা বাঁচবে, বাঁচবে অনেক জুনিয়র অফিসারের বা পিওনের চাকরি। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে প্রতিষ্ঠান বাঁচলে আমি বাঁচবো। সংকটে তাই ব্যয় ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও কৃচ্ছ্রসাধনই মোক্ষম অস্ত্র।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক।