আশঙ্কাজনক খবর হলো, দেশের কোথাও কোথাও স্কুল কলেজের খোলা মাঠে জমায়েত করে নামাজ আদায় করার পাশাপাশি ধুমছে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম দেশের একটি থানা পর্যায়ের এলাকায় একটি কলেজের মাঠে শত শত মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে। একটু আগে সেখানে জমায়েত করে নামাজ আদায় করা হয়েছে। একজন সরকারি কর্মকর্তা তাদের বুঝাচ্ছেন। অথচ তাদের মাঝে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। বরং সাধারণ মানুষ ওই সরকারি কর্মকর্তার কথায় একটু যেন বিরক্ত। ওই সরকারি কর্মকর্তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থলে এসেছেন। তিনি বিস্মিত কণ্ঠে মানুষগুলোকে বোঝাচ্ছিলেন, ‘এত করে বলার পরও কি আপনারা পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না? আমি জেল দিলাম, জরিমানা দিলাম, কয়েকজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলাম, তাতে কী লাভ হচ্ছে? কোনোভাবেই কোনও লাভ হচ্ছে না। আপনাদের ভালো কথা বললে শোনেন না। আমাদের কী করা উচিত বলেন? আমরা কি ঘরের মধ্যে বসে থাকব? আপনারা যা খুশি তাই করবেন? আপনারা মরে পড়ে থাকেন...কোনও সমস্যা নাই...আপনারা কি চান আমরা তাই করি? সেনাবাহিনী এসে বোঝালো, ইউএনও সাহেব এসে বোঝালো, ওসি সাহেব বোঝালো। আপনারা তো দেখি কারও কথাই শুনছেন না। তাহলে আমরা এক কাজ করি, আমরাই ঘরে গিয়ে বসে থাকি...’
এত কিছু বলার পর মাঠের জমায়েত থেকে একজন অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল, আমাদের ভুল হয়েছে। আমরা আর এভাবে বের হবো না। সঙ্গে সঙ্গে জমায়েতের লোকজন যে যার মতো মাঠ ছেড়ে চলে গেলো। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পর পরিবেশ দাঁড়িয়ে গেলো আগের মতোই। সরকারি লোক চলে গেছে নিশ্চিত হওয়ার পর আবার মাঠের আড্ডা জমে উঠল। যেন মাঠের আড্ডা নাহলে পেটের ভাত হজম হবে না।
রাজধানীর কিছু এলাকা বাদে সর্বত্র চলছে ‘চোর-পুলিশ’ খেলা। বিশেষ করে বস্তি এলাকার চিত্র খুবই ভয়াবহ। একই ঘরে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে থাকে অনেক মানুষ। একই ঘরে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো। কাজেই ঘরের বাইরে আড্ডা দেওয়া ছাড়া তাদের কোনও গতি নেই। আর তাই বস্তির মানুষজন অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের পরামর্শ মানছে না। বস্তির তরুণ ছেলেরা ধুমছে আড্ডা দিচ্ছে গভীর রাত পর্যন্ত। পুলিশ দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ চলে গেলে আবার বেরিয়ে আসে। ‘চোর-পুলিশ’ খেলাই যেন এই সময়ের শ্রেষ্ঠ আনন্দে পরিণত হয়েছে।
করোনা সতর্কতায় সারাদেশে হাট-বাজারের সময়সীমা কমিয়ে আনা হয়েছে। দেশের অনেক স্থানে ব্যবসায়ীরা এই পরামর্শ মানছেন না। করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব অর্থাৎ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। অথচ বাজার ঘাটে এই পরামর্শ উপেক্ষিত হচ্ছে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ সুপারশপে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে বাজার করার দিক নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। দুই দিন আগে গুলশান এলাকার একটি সুপারশপে গিয়েছিলাম। হায়রে ভিড়। বাজার করার ট্রলির জন্য বাইরে অনেকে লাইনে দাঁড়িয়েছে। ভেতরে রীতিমতো যুদ্ধ করার ভঙ্গিতে কেনাকাটা করছেন অনেকে। সুপারশপের একজন কর্মী দূরত্ব বজায় রেখে বাজার করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই তার কথা গ্রাহ্য করছে না। যেন আজ বাজার না করলে কাল কিছুই পাওয়া যাবে না। এমন প্রতিযোগিতা সবার মাঝে।
আমি নিকেতন এলাকায় থাকি। নিকেতন সোসাইটি বেশ সতর্কতার সঙ্গে পুরো এলাকা লকডাউন করে রেখেছে। কিছু গ্রোসারি শপ ছাড়া আর কিছুই খোলা নেই। নিকেতন এলাকায় মসজিদের পাশে একটি ছোট সুপারশপ আছে। সেখানে ‘ওষুধ’ কিনতে গিয়ে দেখি বাইরে লম্বা লাইন। দূরত্ব বজায় রেখে সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ দেখলাম ধোপ দুরস্থ এক ভদ্রলোক এসেই লাইনে না দাঁড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে চাইলেন! প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। তাকে লাইনে দাঁড়ানোর কথা বলা হলো। কিন্তু তিনি লাইনে দাঁড়াবেন না। চোখে-মুখে উদ্ধত ভঙ্গি—জানেন আমি কে? শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভের মুখে তাকে লাইনে দাঁড়াতে হলো।
প্রসঙ্গটা তোলার পেছনে একটা কারণ আছে। দেশের অনেক স্থানে এই ধরনের তথাকথিত প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে করোনা সংক্রান্ত সতর্কতা সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না। ধর্ম মন্ত্রণালয় আপাতত মসজিদে জমায়েত করে নামাজ আদায় না করতে পরামর্শ দিয়েছে। অথচ প্রচার মাধ্যমে দেখলাম দেশের কয়েকজন সম্মানিত আলেম এ ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। একথা সত্য সম্মানিত আলেম-ওলামাদের বক্তব্যকে দেশের সাধারণ মানুষ অনেক গুরুত্ব দেয়। কাজেই তাদের উচিত সরকারের করোনা সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। অথচ অনেকেই তা করছেন না। ইউটিউবে সম্মানিত কিছু আলেম ও ধর্মীয় বক্তার এমন কিছু ‘ওয়াজ’ ঘুরে বেড়াচ্ছে যা করোনা সতর্কতায় মারাত্মক হুমকির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরছি। একজন ধর্মীয় বক্তা বলেছেন, এইটা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য, বান্দার জন্য গজব। গজব ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। আরেকজন বয়স্ক বক্তা বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস এইটা কোনও ভাইরাস না। এইটা আল্লাহর মাইর। আল্লাহর অসংখ্য সৈন্যের মইধ্যে এইটা একটা।’ আরেকজন বক্তা বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস কী চালাক, কী ইন্টিলিজেন্ট ভাইরাস, আল্লাহু আকবর? করোনা ক্ষণে ক্ষণে তার চরিত্র বদলায়।’ অন্য একজন তরুণ ধর্মীয় বক্তা বলেছেন, ‘আরে করোনাভাইরাস তো ইহুদিদের জন্য। এটা তো মুসলমানদের জন্য না।’ অন্য একজন ধর্মীয় বক্তা বলেছেন, করোনাভাইরাস নাকি তার সঙ্গে স্বপ্নে দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাস তাকে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য নাকি কোনও ভয় নাই। পৃথিবীতে বাংলাদেশেই ইসলাম ধর্ম নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। কাজেই বাংলাদেশে আক্রমণের ব্যাপারে করোনার কোনও পরিকল্পনা নাই।
করোনা সতর্কতায় ‘মাস্ক’ পরতে বলা হয়েছে। অথচ একজন ধর্মীয় বক্তা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করে বলেছেন, আরে ভাই আমরা নাকে মুখে কিছু না দিয়াই সারাদেশে ঘুরতেছি। আমাদের তো কিছু হইতেছে না। মাইনসে বলদের মতো ৩০০ টাকা দিয়া ‘মাস্ক’ কিনতেছে। আরেকজন ধর্মীয় হুজুর বলেছেন, ‘মাস্ক’ কিনবেন না। বাইরে বের হবার সময় ‘কুলহুআল্লাহ’ পড়ে দুই হাত মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে বেরিয়ে যাবেন। কোনও হুজুরকে দেখছেন ‘মাস্ক’ লাগাইতে? আরেকজন ধর্মীয় বক্তা জোরের সঙ্গে বলেছেন, ১০ টাকার টুপি কিনে মসজিদে ঢোকেন। দেখবেন করোনাভাইরাস আপনাকে দেখে পালিয়ে যাবে।
প্রিয় পাঠক, আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ ধর্মীয় বক্তাদের কথাকে বেশ গুরুত্ব দেয়। কিন্তু সম্মানিত ধর্মীয় বক্তাদের এই যদি হয় বক্তব্যের নমুনা তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী? অনেকে মনে করেন। ধর্মীয় বক্তাদের কারও কারও এমন অসংলগ্ন বক্তব্য করোনা সতর্কতায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। বিষয়টির সুরাহা হওয়া জরুরি।
লেখাটি শেষ করি। তার আগে একটি কঠিন, কঠোর নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি করতে চাই আপনাদের। ধরুন আপনার পরিবারের কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো, তখন তাকে চিকিৎসার জন্য একা নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখা হবে। রোগীর সঙ্গে দেখা করার কোনও ভিজিটিং আওয়ার থাকবে না। তার যত্ন নেওয়ার জন্য পরিবারের কাউকেই পাওয়া যাবে না। রোগী যদি ভালো হয়, তবে পরিবারের কাছে ফিরে আসবে। আর ভালো না হলে পরিবারের সদস্যরা আর কখনই তাকে দেখতে পাবে না। আপনাকে শুধু এইটুকু জানানো হবে, আপনার রোগী আর বেঁচে নেই।
প্রিয় পাঠক, এটাই হলো সময়ের করুণ বাস্তবতা। করোনার কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। অপরিচিত কারও সংস্পর্শে না গিয়ে ‘ঘরবন্দি’ থাকাই হলো এর প্রতিষেধক। কাজেই কিছুদিনের জন্য ঘরে থাকুন, প্লিজ...
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো