শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদ দিয়ে কীভাবে এগোবে বাংলাদেশ?

মোস্তফা মল্লিকটেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি’র চার নম্বর লক্ষ্যটি হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আবার সাতটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যেগুলো সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার ছাড়া কোনও দেশের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব নয়। সাতটি লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সব ছেলেমেয়ে যাতে ফ্রি, বৈষম্যহীন ও মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত শেষ করতে পারে এবং নিশ্চিত করতে পারে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা’।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার। কিন্তু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬ হাজারের কম। তখন চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষার্থীদের পঞ্চমের স্তর পার হয়ে অষ্টমে পৌঁছা। প্রাথমিক পাস করা সব শিক্ষার্থী যাতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারে সেই সুবিধার্থে কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। শিক্ষানীতি-২০১০-এ বলা হয়েছে একই কথা।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২১ হাজার ছাড়িয়েছে। এখন পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ৯৬ শতাংশ শিশু ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে। অর্থাৎ শিক্ষায় অনেক এগিয়েছি আমরা। আমাদের সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে লেখাপড়ার খরচ কম। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ অভিভাবকেরই এই অর্থ খরচ করতে খুবই কষ্ট করতে হয়। অনেকের পক্ষে কষ্ট করেও জোগাড় করা সম্ভব হয় না সন্তানের জন্য অর্থ। সম্প্রতি সাড়ে তিনশ’র ওপরে বেসরকারি স্কুলকে সরকারি করার এবং কয়েকটি নতুন সরকারি স্কুল নির্মাণের পরও দেশে মাধ্যমিক স্তরে সরকারি স্কুলের সংখ্যা মাত্র ৬৮৫টি।

বর্তমানে সরকারি স্কুলে পড়ছে এমন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র ৬.৩ শতাংশ। আর ৯৩.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে ১৯ হাজার ৮০২টি বেসরকারি স্কুলে।

সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে এখন শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৫০ হলেও বেসরকারি স্কুলে এই অনুপাত ১:৪৬। অথচ শিক্ষার ৯৫ শতাংশই যেখানে বেসরকারি, সেখানে এমপিওভুক্ত ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ শিক্ষককে সরকারি বেতন দেওয়া ছাড়া সরকারের টেকসই অর্থ বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বরং শতভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাড়ি ভাড়ার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট নিচ্ছে সরকার। পরীক্ষার ফলাফলে সম্মিলিত মেধা তালিকার যুগে কিংবা জিপিএ পদ্ধতি প্রবর্তনের পর শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সেরাদের সেরা সব সময়ই এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যদিও ভালো ফলে এগিয়ে থাকা ক্যাডেট কলেজ ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে সরকারি ব্যয় প্রচুর। ব্যয়ের দিক দিয়ে এগিয়ে জেলা স্কুলগুলোও।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের তথ্য মতে দেশে বেসরকারি মহাবিদ্যালয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৩৬৩টি। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৬ হাজার ১০৯টি। বেসরকারি মাদ্রাসার সংখ্যা ৭ হাজার ৫৯৮টি।

বর্তমানে এমপিওভুক্ত ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা ৫ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে ১ কোটি ৬২ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৪ জন শিক্ষার্থী। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে সরকারের প্রতি মাসে খরচ ৮শ’ কোটি টাকা।

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আবার প্রায় দেড় লাখ শিক্ষক রয়েছে যারা বেসরকারি। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকে হয় তাদের বেতন।

সারা দেশে বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে প্রায় চার হাজারের মতো। যারা সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন ছাড়া আর কোনও ধরনের সুবিধা গ্রহণ করে না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার।

শুধু অনার্স এবং মাস্টার্স পড়ানো হয় এমন কলেজে সংখ্যা দেড় হাজারের কিছু কম। ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিক্ষক রয়েছেন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শুধু মাত্র শিক্ষার্থী টিউশন ফি থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে।

নন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের সংখ্যা ১ লাখের কাছাকাছি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোও শতভাগ বেসরকারি। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে।

সারা দেশে বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে ৫৫৩টি। ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার।

সারা দেশে আরও রয়েছে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন। এগুলোর বেশিরভাগই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। তবে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে থাকে। সারা দেশে ৫ লাখ শিক্ষক রয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১ কোটি।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে ৯ হাজার। এ মাদ্রাসাগুলোও বেসরকারিভাবে পরিচালিত। এসব মাদ্রাসায় শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। মূলত প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে থাকে এসব প্রতিষ্ঠান।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি ৫০টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে কর্মরত আছেন ২ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে থাকে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রয়েছে ১৪টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। আর ৯৫ শতাংশ শিক্ষা যেসব বেসরকারি বিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত, ওই শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। শিক্ষার যে বিশাল বাজেট, সেখান থেকে কোনও অংশই যায় না এসব প্রতিষ্ঠানে।

শিক্ষা খাতে চলতি অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ছিল ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। খাতওয়ারি বরাদ্দ করা অর্থের দিক দিয়ে শিক্ষা দ্বিতীয় অবস্থানে। কিন্তু তাতে কী? এর মধ্যেও আছে নানা কারসাজি। এই সরকারের সময়ে একবার বাদে প্রতিবারই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০ থেকে ১২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় তার অধিকাংশই চলে যায় বেতনভাতা ও অবকাঠামো খাতে। প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য সরকারি বই—সরকারের এমন নীতির কারণে বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শুধু সরকারি বই পায় বটে, এর বাইরে শিক্ষা বাজেটের কোনও অর্থই তাদের কাছে পৌঁছায় না। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আধুনিক ভবন নির্মাণে বেশি নজর দেওয়া হয়। যদি এর আগেও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকার ভবন করে দিয়েছে। এর বাইরে শতভাগ বেসরকারি স্কুল আর বেসরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের কোনও বরাদ্দই নেই। অথচ মাধ্যমিক শিক্ষায় ৯৩.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়ছে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। বেসরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে পড়ছে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে আবার পুরোপুরি বেসরকারি কলেজে পড়ছে ৫২ শতাংশ শিক্ষার্থী।

৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৫ লাখ ২০ হাজার ৩৮৮ জন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২০ শতাংশ। অপরদিকে বেসরকারি ৯০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭৯২ জন। আর শিক্ষকের সংখ্যা ১৬ হাজারের কিছু বেশি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:২৩ শতাংশ। দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্জন যেমন অনেক, তেমনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনকেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বরং তড়তড় করে সাফল্যের ইতিবাচক দিকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকেই বেশি এগোচ্ছে। যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সফলতার কথা বলা হয় তখন অবশ্য সার্টিফিকেট বিক্রির প্রশ্নও আসে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন সনদ বিক্রির উদ্দেশ্যে গড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগকেই জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পেরেছে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল কেলেঙ্কারির সংবাদও কি গণমাধ্যমে কম আসে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ মেধাবীকে গুরুত্ব না দিয়ে যখন কম মেধাবীকে নেওয়া হয় আর ঘটে আত্মহত্যার ঘটনা—সেই সংবাদগুলোও তো আসছে গণমাধ্যমে।

করোনার এমন মহামারিতে বেসরকারিভাবে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের জন্য এই মুহূর্তে বিশেষ অনুদান দেওয়া না হলে তাদের মধ্যে অনেক মেধাবী শিক্ষক বেকার হয়ে যাবেন। কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কারণ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তাদের অবদান অনেক। প্রশ্ন হচ্ছে পুরো দেশ গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান কি এর চেয়ে কম? শিক্ষকদের অবদানকে কি কখনও খাটো করে দেখার সুযোগ আছে? ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রথম খুলে দেওয়া হবে লাইব্রেরি। আর আমাদের এরই মধ্যে খুলে দেওয়া হয়েছে বাজার ও গার্মেন্টস। শিক্ষার্থী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষকদের বাদ দিয়ে কি কখনও এগিয়ে চলবে বাংলাদেশ? উত্তর যদি হয় না, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে—কী করণীয় আছে সরকারের?

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি চ্যানেল আই, সভাপতি, বাংলাদেশ এডুকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম-বিইআরএফ