X
বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

শিক্ষা আইন চূড়ান্ত হবে কবে?

মোস্তফা মল্লিক
৩০ আগস্ট ২০২০, ১২:০১আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২০, ১৪:১১

মোস্তফা মল্লিক শিক্ষা আইন ২০২০-এর খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে গণমাধ্যমকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব কিংবা শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বেশ কিছু অনুষ্ঠানে শিক্ষা আইন নিয়ে কথা বলেছেন। সেগুলোর সূত্র ধরে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক এবং অনলাইন গণমাধ্যমে আসছে নানা খবর।
জানা গেছে, ৫৮টি ধারা রয়েছে শিক্ষা আইন ২০২০-এর খসড়ায়। ২০১০ সালে করা হয় শিক্ষানীতি। এরপর দফায় দফায় শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি এখনও। কেন পারা যায়নি সে বিষয়ে নানা অভিযোগ বা গল্প শোনা গেলেও নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। যদিও শিক্ষার বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হতো শিক্ষা আইন কার্যকর থাকলে।
শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ২০০৯ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তৎকালীন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন কমিটির চেয়ারম্যান। ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদসহ ১৮ জন ছিলেন কমিটির সদস্য। চূড়ান্ত শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আট বছরব্যাপী হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি শেষে অভিন্ন প্রশ্নে এখন যে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে জাতীয় ভিত্তিতে বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় অভিন্ন প্রশ্নে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় তা জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক বৃত্তি পরীক্ষা না নিয়ে বরং এই দুই পরীক্ষার সেরা মেধাবীদের বৃত্তি দেওয়ার যে রেওয়াজ চালু আছে তাও শিক্ষানীতির কারণে। এই নীতিতে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত হবে বলা হলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক স্তরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত বিষয়গুলো হবে এক অভিন্ন, এর ফলে বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে- শিক্ষানীতির এমন গুরুত্বপূর্ণ ধারাও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার জন্য শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দু’দফা দায়িত্ব পালন করা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সবসময়ই শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করার তাগিদ দিয়ে এলেও বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।

এবার আসা যাক আসল কথায়। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে বিদ্যমান চার স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক স্তর। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু উচ্চশিক্ষা। যদিও শিক্ষানীতিতে আছে ভিন্ন প্রস্তাব। তবে আইনে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের কথা বলা হয়েছে। যেটি বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বর্তমানে প্রাক-প্রাথমিক এক বছর মেয়াদি হলেও এখন করা হচ্ছে দু’বছর মেয়াদি। দেশে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার পর এই শ্রেণির জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করে সরকার। যার ফলও দ্রুত পেতে শুরু করে লাল সবুজের বাংলাদেশ। এশিয়ায় প্রাক-প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে কিন্ডার গার্টেন ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার কারণে সবার জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব নয়। তবে আইনে সরকারের পূর্বানুমতি নিয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে যেখানে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে হিড়িক তার কিছুটা হলেও লাগাম টানা সম্ভব হবে। কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন ছাড়া প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যাবে না বলেও উল্লেখ আছে শিক্ষা আইনে। আইন কার্যকর হলে ইংরেজি মাধ্যমে (ইংরেজি ভার্সন নয়) পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে।

প্রাস্তাবিত আইনে নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাজারজাত করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। যদিও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, তিনি নিজেও সাংবাদিকদের কাছ থেকে এমন তথ্য পেয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই চূড়ান্ত নয়। নোট-গাইডের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর আলোকে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর লেখা থাকে যে পুস্তকে, যা বিক্রি করা হয় বাণিজ্যিকভাবে। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কোনও ধরনের নোট বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। নির্দেশ অমান্যকারীদের অনূর্ধ্ব ৩ বছর কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে। একইভাবে শিক্ষক নোট-গাইড বই শিক্ষার্থীদের ক্রয়ে বাধ্য করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

করোনার এমন সময়ে গত ১৭ মার্চ থেকে দেশে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা কর্যক্রম। তাহলে দীর্ঘ এই সময়ে শিক্ষা থেকে কি দূরে শিক্ষার্থীরা? আসলে শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কোনও সুযোগ নেই। জুলাই থেকে ঢাকা এবং বিভাগীয় বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংসদ চ্যানেলে চালু আছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ভিন্ন ক্লাস। কিন্তু সবাই কি এই অনুষ্ঠান দেখছে? অনলাইনের সুবিধা কি সবাই পাচ্ছে? এটা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনও জরিপ হয়নি। যারা টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে আনন্দ পাচ্ছে না কিংবা টেলিভিশন নেই, যাদের অনলাইনের সুযোগ নেই, তারা কী করছে? বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান করে দেখেছি তারা সবাই গাইড-নোট বইয়ের ওপর নির্ভরশীল। শুধু তাই নয়, টেলিভিশনও দেখছে, অনলাইনেও ক্লাস করছে, তারপরেও তারা আবার গাইড বইও দেখছে। গাইড-নোট বা সহায়ক যে নামেই বলি না কেন, এসব বইয়ের দারুণ চাহিদা শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

কিন্তু কেন? এর উত্তর বারবার খোঁজার চেষ্টা করেছি আমি। কিছু কারণ খুঁজেও পেয়েছি। এই কারণগুলোর সমাধান করা না গেলে এই বইয়ের চাহিদা থাকবেই। প্রথমত সারা দেশে প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত লেখাপড়া করছে চার কোটি ৯০ লাখ শিক্ষার্থী। এরমধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চার কোটি ১৫ লাখ ছাত্রছাত্রী, এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী (বাবা-মা শিক্ষাহীন) শিক্ষার যে আলো পেলো। খুব স্বাভাবিকভাবেই এই শিক্ষার্থীর আস্থার জায়গা হয়ে ওঠে তথাকথিত নোটি বই বা গাইড বই।

যদি প্রশ্ন করি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষক নির্দিষ্ট সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসেন এবং কার্যক্রমে অংশ নেন? আমি জানি আপনারা যারা পড়ছেন তাদের অধিকাংশের উত্তর কি হতে পারে। জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ে শিক্ষা নিয়ে কাজ করি বলে খুব স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা সংক্রান্ত নানা ধরনের ফুটেজ সংরক্ষণে রাখতে হয়। ভাবলে অবাক হবেন, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের যত ভিডিও ধারণ করা আছে সেখানের প্রায় সব শিক্ষার্থীর বেঞ্চে পাঠ্যবইয়ের ওপরে রয়েছে গাইড বই। এর ব্যবহার এতই বেশি যে টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদের ক্যামেরা দেখেও রাখঢাক করেনি শিক্ষার্থী বা শিক্ষকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি যদি খুবই ভালো হয় আর শিক্ষকরা যদি হন বেশ দরদি, তারপরেও বছরে ১৪০ দিন ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় স্কুল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কারিকুলাম তৈরি করা হয় পুরো বছরের কথা চিন্তা করেই। খুব স্বাভাবিকভাবেই স্কুলে শতভাগ পাঠ্যসূচি পড়ানো সম্ভব হয় না। ফলে শিক্ষার্থীরা সহায়তা নেয় নোট বই বা সহায়ক বই বা অনুশীলন বইয়ের।

নোট বই বা গাইড বইয়ের প্রতি অধিক ঝোঁক থাকার আরও বেশ কয়েকটি কারণ আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। ২০০৭ সালে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু হয় ২০০৮ থেকে। আর প্রাথমিক স্তুরে ২০১২ সালে চালু হয় এই পদ্ধতি। এই দুই স্তরে শিক্ষক আছেন প্রায় সাড়ে আট লাখ। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েই সৃজনশীল বিষয়টি না বোঝার কারণেও সহায়ক বই নিয়মিত পড়তে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি চালুর এক দশক পরও দেশের প্রায় ৪২ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে পারেন না। শিক্ষকরা বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করেন বা অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর-মাউশি ২০১৮ সালে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে এমন তথ্য। দেশের ১৮ হাজার ৫৯৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্য থেকে ৮ হাজার ২১৯টি বিদ্যালয়ের ওপর গবেষণা করে এমন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল।

মাউশির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরিশাল অঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র ৩০.৭৬ শতাংশ শিক্ষক এই পদ্ধতিতে প্রশ্ন করতে পারেন। বাইর থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহেও এগিয়ে বরিশাল। প্রতিবেদনে বলা হয়, রংপুর অঞ্চলের ৪৫. ৫০ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতিতে আংশিক প্রশ্ন করতে পারেন। এর আগে ২০১৬ সালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন (রস) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গবেষণা চালিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ১৩ শতাংশ শিক্ষক সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি একেবারেই বোঝেন না। অল্পবিস্তর বোঝেন ৪২ শতাংশ। ওই গবেষণায় বলা হয়, ৪৭ শতাংশ শিক্ষক তাদের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর ক্ষেত্রে প্রচলিত গাইড বইয়ের সহায়তা নেন। এই প্রতিবেদন থেকে বোঝা যায়, শুধু শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকরাও নোট-গাইড বইয়ের সহায়তা নেন।

মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা যেন বুঝে পড়েন সেই চিন্তা থেকেই উন্নত বিশ্বের আদলে বাংলাদেশেও সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রেণিতে একটি অধ্যায় পড়িয়ে দেওয়ার পর ওই অধ্যায় থেকে কেমন প্রশ্ন হতে পারে তা শিক্ষার্থীরাই তৈরি করে। এতে করেও বাড়ে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা। কিন্তু শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতার সুযোগ করে দিতে আমাদের দেশে এটা চিন্তাই করা যাবে না, কারণ এই পদ্ধতিতে দুর্বল শিক্ষার্থী-শিক্ষক উভয়ই। একইভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সহায়তা নেন নোট বই-গাইড বইয়ের।

মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টিং অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, অনুশীলনমূলক সহায়ক বই পড়ে না, এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। সেরা শিক্ষার্থীর টেবিলেও দেখেছি একাধিক অনুশীলনমূলক বই। আমার কাছে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেওয়া আছে, যারা বলেছে, নোট বই-গাইড বা ওই বিষয়ক অন্য কোনও অনুশীলনমূলক বই নিয়মিত চর্চা করে। শিক্ষার্থীরা অনুশীলনমূলক বই পড়ুক, এর নির্ভরতা বাড়ুক, এটা মোটেই চাই না আমরা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা যখন এমন তখন এটা পুরোপুরি বন্ধ করাও সম্ভব হবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। কারণ, আইন করে সবকিছু বন্ধ করার সুযোগ নেই, পারাও যায় না। 

সবচেয়ে বড় কথা অনলাইনের এমন সময়ে পৃথিবীতে গোপন বলে কিছু নেই। সার্চ ইঞ্জিনগুলো বসেই থাকে বিশ্ব নাগরিকদের সেবা দেওয়ার জন্য।

তাহলে কী এখন উপায়? আমার কাছে মনে হচ্ছে সবকিছুর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না করে যদি প্রচলিত সহায়ক বা অনুশীলনমূলক বই বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে দেশে আন্ডারগ্রাউন্ড প্রকাশকের সংখ্যা বেশিমাত্রায় বেড়ে যাবে। মানহীন বইয়ে ছেয়ে যাবে বইয়ের বাজারগুলো। কারণ, মনে রাখতে হবে এই খাতে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ ১০ হাজার। একাধিক মানসম্মত প্রকাশকও রয়েছে বাংলাদেশে। এমন বেশ কয়েকটি প্রকাশনা রয়েছে, যারা সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বেশ কিছু দেশের সহায়ক বই প্রকাশ করে বাংলাদেশ থেকেই। প্রয়োজন হচ্ছে নামসর্বস্ব প্রকাশকদের নিষিদ্ধ করা। সত্যিই যারা পাঠ্যবইয়ের অনুকরণে কিছু প্রশ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে তাদের আইন করে দমন করা। আর পুরো খাত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। অনুশীলনমূলক বইয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা। সরকারের একটি কমিটি গঠন করা, যারা সহায়ক বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণ করবেন। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই খাতে অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শুধু আইন করে বন্ধ করলেই কার্যকর ফল পাওয়া যাবে বলে আমার কাছে মনে হয় না।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে কোচিংয়ের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সরকারি বা স্বীকৃত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে কোনও ব্যক্তি বা শিক্ষক কর্তৃক এক বা একাধিক শিক্ষার্থীকে কোনও প্রতিষ্ঠানে বা নির্দিষ্ট স্থানে অর্থের বিনিময়ে পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষা আইনে প্রাইভেট টিউশন সম্পর্কেও স্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক অর্থের বিনিময়ে মূল শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে যেকোনও স্থানে শিক্ষা প্রদান করা। আইনে কোচিং সংক্রান্ত বিধানে বলা হয়েছে, কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করাতে পারবে না। এখানে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, কোনও শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। নির্দেশনা অমান্য করলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। তবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল সময়ের আগে বা পরে নীতিমালা অনুসরণ করে ক্লাস নেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি প্রয়োজন হবে। এর সবকিছুই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে অভিভাবকরা আর্থিকভাবে লাভবান হবেন।

তবে এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়কে আরও কিছু ভালো কার্যক্রম গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। কোচিংয়ের দাপটে মূল শ্রেণিকার্যক্রম ব্যাহত হয় এমন সংবাদ আমাদের সবারই কমবেশি জানা আছে। আবার কোচিংকে নিরুৎসাহিত করেন এমন শিক্ষকের সংখ্যাও আছে প্রচুর। সেসব শিক্ষকের স্বার্থরক্ষায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ঢাকার একাধিক শীর্ষ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে ২০-২৫ বছরের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের বেতন এখনও বলার মতো পর্যায়ে আসেনি। কারণ, ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ধরেই নিয়েছে, শিক্ষক যোগদানের পর থেকেই কোচিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়বেন, তাই তাঁর মানসম্মত বেতনের প্রয়োজন নেই। একই সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কিছুটা সুযোগ সুবিধা আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে আবাসন ব্যয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের রক্ষা করার জন্য সরকারের এমন উদ্যোগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালিত বাণিজ্যিক কোচিংকে নিরুৎসাহিত করবে বলে মনে হয়।

প্রস্তাবিত আইনে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা নিষিদ্ধ হবে না। কোচিং সেন্টার মূল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর খোলা রাখা যাবে। বেকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এমন শিক্ষার্থী, যারা টিউশনি করে কিংবা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করে অর্থ উপার্যন করেন, তাদের জন্য আইনের এই ধারাটি খুবই কার্যকর। একই সঙ্গে এটি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত মানসম্মত কোচিংগুলোর জন্যও টেকসই আইন। তবে ঢালাওভাবে যেন বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টার বৈধতা না পায় সেদিকেও মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

উচ্চ শিক্ষা নিয়েও আইনে এমন অনেক ধারা রয়েছে যেগুলো শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রশাসন উৎসাহিত হবে। যেমন, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থী মূল্যায়ন অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ নিতে অবশ্যই ৬০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর সবই ইতিবাচক দিক। তবে এর বাইরেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনার বিষয়টি ভেবে দেখা জরুরি। করোনার এমন সময়ে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যলয়ের আর্থিক ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে। তাই গবেষণা চালু রাখার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্ব কমানো প্রয়োজন। কারণ, ভবিষ্যৎ উন্নয়নে অবদান রাখা দেশের সন্তানরা কখনও সরকারি বা বেসরকারি হতে পারে না। এমন গুরুত্ব অনুধাবন করে ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি প্রয়োজন। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা, গবেষণাকে আরও উৎসাহিত করা, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগের ন্যূনতম যোগ্যতার নীতিমালা, মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণ, কোর্স কারিকুলাম, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক উচ্চমানের জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বর্তমান সরকারের সময়ে। এখন সবকিছু বিবেচনায় এনে বিশাল এই শিক্ষা খাত রক্ষার জন্য শিক্ষা আইনটি খুবই জরুরি। ২০১০ থেকে ২০২০, এত বছরে শিক্ষা আইন না পাওয়া সত্যিই দুঃখজনক।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, চ্যানেল আই। সভাপতি, বাংলাদেশ এডুকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম-বিইআরএফ।

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সড়কে প্রাণ গেলো আম ব্যবসায়ীর
সড়কে প্রাণ গেলো আম ব্যবসায়ীর
নিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আত্মসাৎনিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
দেশের ৪২ জেলায় বইছে মৃদু তাপপ্রবাহ, বিস্তারের শঙ্কা
দেশের ৪২ জেলায় বইছে মৃদু তাপপ্রবাহ, বিস্তারের শঙ্কা
নিজঘরে নারীর মরদেহ, স্বামী পলাতক
নিজঘরে নারীর মরদেহ, স্বামী পলাতক
সর্বশেষসর্বাধিক