দেশীয় চ্যানেলগুলো তাদের অনুষ্ঠান তৈরির কৌশল ও মানে বড় ধরনের কোনও বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলল? মোটেও না। দর্শকরা বাধ্য হয়ে দেশীয় চ্যানেলে ফিরে এসেছে। করোনার লকডাউনে কলকাতার ধারাবাহিকের শুটিং বন্ধ। ভারতের চ্যানেলগুলোতে নতুন কোনও অনুষ্ঠান নেই। তাই স্থানীয় দর্শকরা ফিরেছেন দেশীয় চ্যানেলে। এখানে যে ভালো মান ও বিনোদনের আয়োজন রয়েছে তা নয়। মানুষ কোভিড-১৯ মহামারির হালনাগাদ খবর ও করোনার চিকিৎসা সম্পর্কে জানতেই চোখ রাখছেন দেশীয় চ্যানেলে।
খবরের চ্যানেলগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শুরু করেনি যে, তাদের সেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দেখতে দর্শকরা ভিড় করবেন। বরং খবরের চ্যানেলগুলো আগের মতোই ‘কাভারইজম’ চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দফতরের বুলেটিন, ভাষ্য প্রচারের মাধ্যম হয়ে অতিবাহিত করছে করোনাকাল। কিছু মানুষের অভিযোগ, সেই অভিযোগের সাফাই দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টে ভাগ বসানোর লড়াই করোনাকালের আগের মতো এখনও চলছে। মূল টেলিভিশনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যুক্ত করে ভোক্তা ধরার কৌশলটাও পুরনো। চটকদার শিরোনাম দিয়ে ভোক্তাকে ফাঁদে ফেলা। করোনাকালে বিজ্ঞাপন কমে গেছে যেমন কিছু চ্যানেলের, আবার কিছু চ্যানেলের বিজ্ঞাপন স্থিতাবস্থাতেই রয়েছে। শঙ্কার কালেও কেউ কেউ তুলছেন তৃপ্তির ঢেঁকুর।
খবরের চ্যানেলের অন্যতম পুঁজি ‘টকশো’। এই টকশো এখন চলছে রকমারি সফটওয়্যারের মাধ্যমে। অতিথিদের তালিকায় রাজনীতিবিদ সরে গিয়ে শুধু যুক্ত হয়েছেন চিকিৎসক। সেখানেও রাজনৈতিক দল বা নেতাদের মতো পক্ষ-বিপক্ষ টেনে এনে কৃত্রিম তর্ক-বিতর্ক, উত্তেজনা আনার চেষ্টা।
খবরের চ্যানেলগুলোর মূল সমস্যা, তারা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছেন। বা কোনটি মূলত প্রশ্ন তা বুঝতে পারছেন না। যদিও রিপোর্ট ও টকশো দেখলে মনে হবে অফুরন্ত প্রশ্ন আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে সেই প্রশ্নগুলো শেষ পর্যন্ত আর প্রশ্ন হয়ে উঠছে না। কোনও একটি পক্ষকে ইচ্ছে করে হেয় ও বিপর্যস্ত করা। অন্যপক্ষকে প্রতিষ্ঠিত করা তারকা বা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে। এখানে সম্পাদকীয় বিবেচনা ও নির্মোহ অবস্থান বিরল। এটি চরিত্র গণমাধ্যমের ব্যর্থতার প্রকাশ। এই ব্যর্থতার দায় অনেকে সরকারের প্রশস্ত কাঁধে চড়িয়ে দেন। মহামারি, জাতীয় বিপর্যয় ও সংকটে সরকার তার একটি অবস্থান গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেয়। সেটির কারণ হিসেবে বলা হয় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার কথা। এটি এই ডিজিটাল সমাজের বাস্তবতাও বটে। কিন্তু সরকারের এই অবস্থান অক্ষুণ্ন রেখে গণমাধ্যমের পক্ষে কি ভোক্তার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়? আছে অবশ্যই। কিন্তু রাষ্ট্রের সুরক্ষার চেয়ে তাদের শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যক্তির সুরক্ষার প্রতি নজর রাখতে হয় বেশি। আমাদের খবরের চ্যানেলগুলো গাল গপ্পের সময় সিএনএন, আল জাজিরা, বিবিসি, এনডিটিভি’র উদাহরণ টেনে আনতে পারেন। কিন্তু নিজেরা যখন খবর তৈরি ও পরিবেশন করেন, তখন আর সেই উদাহরণগুলোর কথা স্মরণে রাখেন না। ভাবেন ভোক্তাকে যা দেবেন তাই তারা লুফে নেবেন। একই আচরণ অনুষ্ঠান চ্যানেলগুলোরও। তারা প্রতিবেশী দেশের অনুষ্ঠানগুলোর ‘কাট অ্যান্ড পেস্ট’ ছাড়া আর কোনও উপায় জানেন না। ভাবেন অমন অনুষ্ঠান মুখে তুলে দিলেই হবে। না হয় না। আসল রিমোটের হাতে থাকতে নকল কেন মুখে তুলবে?
করোনাকাল না থাকলে এবারও আগের বছরগুলোর মতোই প্রায় তিনশ’ নাটক, টেলিফিল্ম তৈরি হতো। যার বেশিরভাগই থাকতো ভাঁড়ামি ভরাট। নতুনত্ব হয়তো দুই একটি নির্মাণে থাকতো। কিন্তু ভাঁড়ামিপনার অতলে সেগুলো হারিয়েই যেতো। যেহেতু পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনকারীরাই নাটকের বিষয় ও পাত্র-পাত্রী ঠিক করে দিচ্ছে, সেখানে সৃজনশীলতার জায়গা নেই। সেখানে আছে শুধু বেচো আর খাওয়া শব্দ দুটো। করোনাকালে দেশীয় টেলিভিশনগুলোর কাছে সুযোগ এসেছে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার। এই যে ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ দর্শক এলো, তাদের আটকে রাখা। আর দেশীয় চ্যানেলের পর্দা ছেড়ে যেতে না দেওয়া। এজন্য দরকার প্রান্তিক হিসেবে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা। অনুষ্ঠানের মান ও সৃজনশীলতার প্রতি যত্নবান হওয়া। অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য যথাযথ খরচ বরাদ্দ দেওয়া। খবরের চ্যানেলগুলোকেও টকশো, বুলেটিন উপস্থাপনা, সংবাদের বিষয় নির্বাচনে মনোযোগী হওয়ার দরকার ছিল। উভয় ধরনের টেলিভিশন একটি জরিপও চালাতে পারতো। দর্শকরা আসলে টিভিতে কেমন অনুষ্ঠান ও খবর দেখতে চাচ্ছেন। শিল্পী, কলাকুশলী ও চিন্তক শ্রেণির সমন্বয়ে সংলাপের ব্যবস্থা করা যেতো টেলিভিশনের জন্য করণীয় বিষয় নিয়ে। না। আমাদের টেলিভিশনগুলোকে সেদিকে মন দিতে দেখলাম না। বরং তাৎক্ষণিক দর্শক বাড়তি দেখিয়ে মুফতে কিছু রোজগার করা যায় কিনা সেদিকে দৌড়াচ্ছে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কারও উদ্যোগ নেই। ফলে করোনাকাল গেলে টেলিভিশনগুলো আরও গভীর অসুখে পড়বে। সেই অসুখ পণ্যের বিক্রেতার কাছে তার নির্ভরতা আরও বাড়াবে। টিকে থাকার মতো সুরক্ষা অনেকের থাকবে না। আসলে বোকা বাক্স বোকাই থেকে গেলো। সুযোগ পেয়েও নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কাজটি করতে পারলো না। সেজন্য দুঃখ রয়েই গেলো।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি