প্রশ্ন হচ্ছ, আমাদের দেশে জেন্ডার বাজেটের এই বিশাল অংশে মেয়েদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারটি কোথায়? নিরাপদ মাসিক একটি মেয়ের অধিকার। মেয়েদের মা হওয়াকে বাজেটে যত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ঠিক মা হওয়ার পূর্ব প্রক্রিয়াকে বাজেট গুরুত্ব দেয়নি। অথচ নারী তার শ্রম দিয়ে এই জিডিপি মেশিনের চাকাকে সচল রেখেছে, অদৃশ্য কাজ দিয়ে রাষ্ট্রকে আগলে রেখেছে, কিন্তু রাষ্ট্র তার শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ মাসিক স্বাস্থ্যকে নিয়ে কথা বলার দরকার মনে করেনি। আর তাই এখনও বাজারে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পণ্যগুলোর অহরহ অপ্রাপ্যতা, উচ্চমূল্য, অস্বাস্থ্যকর পণ্যের ছড়াছড়ি, সর্বোপরি চারপাশে নিষিদ্ধতার বেড়াজাল।
ডানকান ব্রাদার্সের চা বাগানে কাজ করা মেয়েটি প্যাড বা মাসিকের অন্যান্য ব্যবস্থাপনার নামগুলো শোনেনি। মাসিকের ব্যবহৃত কাপড় সঠিক পদ্ধতিতে পরিষ্কার করার কথা সে জানে না। মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের এই স্বাস্থ্য নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে আলাদা চ্যাপ্টার থাকলেও তা পড়ানো হয় না। ঢাকা শহরে বাড্ডার মতো এলাকায় নারী শিক্ষকরা মেয়েদের সঙ্গে সামনাসামনি এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলা দরকারি মনে করে না। গ্রামবাংলায় হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ইনজেকশন কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির যে প্রচারণা করেন, তাদের কেউই মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলে না। অথচ তাদের সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে যাওয়াটা মামুলি ব্যাপার ছিল। কিন্তু তার জন্য চাই বাজেটে আলাদা খাত। সেটি কই?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে মেয়েদের প্রতি মাসের প্যাডটি যদি বিনামূল্যে দেওয়া হতো, বাংলাদেশের অনেক মেয়ে স্কুল পড়াকালীন সুষ্ঠু মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অভ্যস্ত হতে পারতো! প্রতিটি স্কুলে আলাদা করে উন্নয়ন বাজেট রয়েছে। ২০১৫ সালের মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরিপত্র বলা হয়েছে, স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্যাডের জন্য এই উন্নয়ন প্রকল্প আলাদা তহবিল তৈরি করতে। কিন্তু আজও গুটিকয়েক স্কুল ছাড়া বেশিরভাগ স্কুল এই পরিপত্র নিয়ে কিছু জানেই না।
ওদিকে বাজারে জেল প্যাডের যে বাণিজ্যিককরণ দিনের পর দিন চলছে, তা নারীর স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। যে প্যারামিটারে টেস্ট করার বদৌলতে বাজারে এই প্যাডগুলো ব্যবসা করার অনুমতি পায়, সেই প্যারামিটার নিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি! বলেনি, শোষণক্ষমতাই মানসম্পন্ন প্যাডের জন্য শেষ কথা না!
আগামী ২০ বছরে প্যাডের জেল থেকে যে শরীরে ক্যানসার জন্ম নিতে পারে সেই ব্যাপারটি মাথায় রেখে মান নিশ্চয়তার মানদণ্ড ঠিক করা দরকার।
আমরা দেখেছি যে কমিউনিটি ক্লিনিকে সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎপন্ন করে বা টেন্ডারের সহায়তায় বিভিন্ন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, কনডম, আয়রনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ দেয়। চাইলে এই জায়গায় রাষ্ট্র মাসিকের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যগুলো বিনামূল্যে দিতে পারে। কিন্তু সেজন্য কথা বলা চাই! জেন্ডারগত স্বাস্থ্য বাজেটে আলাদা ব্রেকডাউন থাকা চাই, কাজের তালিকা থাকা চাই! সেসব কই?
এখনও মাসিক এই দেশে ট্যাবু। যদিও এই ট্যাবু ভাঙছে, তবু চারপাশে যে জেন্ডার বৈষম্যগত একটি সমাজ রয়েছে, সংস্কৃতি রয়েছে সে জায়গা থেকে একটা মেয়ের মাতৃত্বকে বরণ করা হলেও, মাসিকের রক্তকে বরণ করা হয় না। সাংস্কৃতিক যেকোনও পরিবর্তন খুব সহজে আসে না। অন্তত কয়েক যুগ লেগে যায় একটি স্থানের সাংস্কৃতিকগত পরিবর্তন আনতে। কিন্তু মাসিক স্বাস্থ্য যে প্রতিটি মেয়ের একটি অধিকার, সেই অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে আলোচনাটা প্রথমে জরুরি। আমাদের রাষ্ট্র জেন্ডার গ্যাপ ইন্ডেক্সে প্রথম সারিতে রয়েছে। অর্থাৎ বলা হচ্ছে, আমাদের দেশে জেন্ডার গ্যাপ খুব কম! কিন্তু জেন্ডার সমতা রাজনীতিতে এই পরিসংখ্যান আসলে দৃশ্যমান না। আমরা চেষ্টা করছি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপে জেন্ডার সমতাকে নির্মাণ করার, কিন্তু যে দর্শনগত অসাম্য আছে তা দূর করতে একটা লম্বা সংগ্রামের প্রয়োজন।
আগামী ২০২০-২১ বাজেটে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার খাত আমরা দেখতে চাই, দেখতে চাই বরাদ্দ। করোনাকালীন জীবন বদলে গেছে আমাদের। তাই করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে সর্বস্তরে হাইজিন মেনে চলার জন্যেও এই খাতের দরকার। শুধু তা-ই না, করোনাকালীন সরকারি ত্রাণে, রেশনে স্যানেটারি প্যাড বা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পণ্যগুলো অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। ইতোমধ্যে স্কুলগুলোতে সরকার বিনামূল্যে প্যাড দেওয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু তার কোনও নির্ধারিত পরিপত্র এখনও আসেনি। আসন্ন বাজেটেই এ নিয়ে কথা শুনতে চাই আমরা। রাষ্ট্রীয়ভাবে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নির্ধারিত খাত তৈরি করার মাধ্যমেই জেন্ডার সমতার একটি রাষ্ট্রের দিকে আমরা একধাপ এগুতে পারি। কে জানে, মাসিককে নিয়ে ঘিরে থাকা নিষিদ্ধতাগুলোকে ভাঙতে রাষ্ট্রের এই ছোট্ট পদক্ষেপে বিশাল ভূমিকা পালন করবে না।
লেখক: আহ্বায়ক, নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফোরাম