এই সময়টায় পাড়া চুপচাপ হয়ে ছিল গত প্রায় আড়াই মাস। মানুষের হৈচৈ কম। শুধু পাখপাখালির কথোপকথন। ওদের ফিসফিস করে বলা কথাও শুনতে পেতাম। আজ বাইরে বড় আওয়াজ। হকার, গাড়ি, মানুষের চিৎকারে পাঁচতলায় টিকে থাকাই মুশকিল। অন্যদিকে অঘোষিত লকডাউনেও ছুটির ফুর্তি আমেজ থাকলেও, আমাদের দিকে এতটা ছিল না। আজ যেন ছুটি শেষে সবাই পথে নেমে এসেছে। উঁকি দিয়ে দেখি মানুষে মানুষে মোলাকাত। এতদিন পর গলিতে হকার পেয়ে কেউ কেউ যেন আবেগে আপ্লুত। কত ঘনিষ্ঠ হয়ে কেনাবেচা করা যায় তার মহরত চলছে। যাদের এতদিন ছাদ, জানালা বা বারান্দায় দেখেছি মাস্ক মুখে, পথে নেমে এসেছে মাস্ক ছাড়াই। পাখপাখালিদের না পেয়ে মন খারাপ করেই অফিসের পথে বের হই। পথের যে চিত্র দেখলাম, তার নাম কি দেওয়া যায় ‘ছুটির শেষে’? দীর্ঘ রমজান বা গ্রীষ্মের ছুটি শেষে বিদ্যায়তনে যে আনন্দ নিয়ে যেতাম, মানুষ বুঝি তেমন আনন্দ উদযাপনেই পথে নেমেছে। এমন আনন্দ খানিকটা ঈদের দিনেও দেখেছিলাম। কিন্তু আজ যে মহাআনন্দ। তবে কাল কী হবে? কালতো সব সত্যিই খুলে যাচ্ছে। যাদের পথে দেখছি কেউ স্বাস্থ্যবিধির ঘেরাটোপে নেই। চলছে যেমন খুশি তেমন করে। সেলুনে, মুদিতে, সুপারশপে মানুষ ফিরে গেছে আগের দিনে। রিকশা, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা, ব্যক্তিগত বাহন এবং যিনি হাঁটছেন, তারা সকলেই যেন ফিরে যেতে চাচ্ছেন করোনা পূর্ব দিনে।
অথচ এখন করোনাকাল চলছে। পৃথিবী কোনোভাবেই আর করোনা পূর্বকালে ফিরে যেতে পারবে না। কবে করোনা পরবর্তীকাল আসবে তাও অজানা এই মুহূর্তে। দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। এখন দিনে আড়াই হাজার শনাক্ত হয়। মৃতের সংখ্যা প্রায়ই বিশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই ব্যক্তিগত ও সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচিতজনরা বিদায় নিচ্ছেন। আজ সকালেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া কত পরিচিতের কথা জানলাম। মৃত্যুর মিছিলে মানুষ যখন একটি সংখ্যায় পরিণত হলো, তখন আমরা কীসের নেশায় পথে নামলাম, ইতি টানলাম ছুটিতে? অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কথা বলা হচ্ছে। মৃত্যুর চূড়ায় উঠে কেন অর্থনীতিকে চনমনে করার কথা ভাবা হচ্ছে। ঝুঁকি নিলে বৈশাখ আর রমজানে নিলেই হতো। তখন আক্রান্ত ও মৃত্যুর অঙ্ক কম ছিল। এবং সকল শ্রেণির ব্যবসায়ীর সারা বছরের ব্যবসার মূল মুনাফা বা বিনিয়োগে উঠে আসে এই সময়টায়। তারপর না হয় আমরা ছুটিতে যেতাম। ঈদের পর অর্থনীতি এমনিতেই ঝিমুনিতে থাকে। তখন কেন তাকে সতেজ করার চেষ্টা। বাজেট ঘোষণার পর জুনের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতো। অনেক অর্থনীতিবিদের এমনই অভিমত।
তরুণদের অনেকে জানতে চান, আচ্ছা করনোকালে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে পাচ্ছি না। কেউ কেউ ফেসবুকে হাস্যরস করছেন লেখা ও বলাতে। সেখানে করোনাকাল পেরিয়ে বাংলাদেশ যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, তা নিয়ে তাদের কোনও ভাবনাচিত্র নেই। সরকারের সমালোচনাই করতে হবে এমন দায়তো কোনও বুদ্ধিজীবীকে নিতে বলিনি। সরকার, জনমানুষ কি পথ অবলম্বন করতে পারে এই সংকটকালে সেই ব্যবস্থাপত্রও তো তারা দিতে পারতেন। আর একটি বড় অংশতো বিত্তশালীদের মতো উড়োজাহাজ নিয়ে উড়ে গেলো কিনা বুঝতে পারছি না। আফসোস করে তারা বলেন, এদের কল্প-স্বপ্নতে ভুলে বইয়ের আলমিরা ভরাট করেছি, বইমেলায় হেঁটেছি মাইলের পর মাইল। হৃদয়ের জমিন অপচয় করেছি? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে কিনা জানি না। শুধু বলি দেখুন করোনাকালীন সময়ে বিশুদ্ধ হওয়ার যে সুযোগ পেয়েছেন, সেই সুযোগ কাজে লাগাই চলেন। বুদ্ধিজীবীরা এখনও পুরনো মুখোশগুলো সব খুলে শেষ করতে পারেননি। তাদের নির্দেশনার অপেক্ষায় থেকে করোনাপূর্ব সভ্যতার শুধু অপচয়ই হয়েছে। নতুন পৃথিবী সেই অপচয়মুক্ত হোক।
লেখক: বার্তা প্রধান, সময় টিভি